নগরে নতুন দিনের যাত্রা

গত সোমবার তেজগাঁও কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুর রশীদ অডিটরিয়ামে রাজিয়া সুলতান–এর উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করেছে কলেজটির থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগছবি: খালেদ সরকার

যাত্রা! যাত্রা! যাত্রা! এই ভঙ্গিতে এখন আর ঘোষণা করা হয় না যাত্রাপালার খবর। এখন ফেসবুকে ঘোষণা দেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে হ্যাজাক বাতি জ্বেলে যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করার রীতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। নগরের সুধীজনের সামনে, সুসজ্জিত মিলনায়তনে নতুন রূপে নাগরিকের কাছে ফিরেছে নতুন দিনের যাত্রা।

দেশব্যাপী ১০০ নতুন যাত্রাপালা মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এগুলোর কোনো কোনোটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাকে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। কোনোটিতে যুক্ত হয়েছে নতুন গল্প, মঞ্চে এসেছে পরিবর্তন, আলোক ব্যবস্থাপনায় এসেছে নতুনত্ব। এসব পালার অভিনয়শিল্পীদের পোশাক, সংলাপ ও প্রপসে ছিল যাত্রাপালার চিহ্ন।

ধরা যাক ‘রাজিয়া সুলতান’–এর কথা। গত সোমবার তেজগাঁও কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুর রশীদ অডিটরিয়ামে এ পালার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করেছে কলেজটির থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ। এই অঞ্চলের প্রথম মুসলিম নারী সুলতান রাজিয়ার জীবন নিয়েই এই পালা। যুদ্ধক্ষেত্রে অবদান, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, প্রেম, সিংহাসনের সংকট নিয়ে পালার কাহিনি। চারপাশ খোলা মঞ্চের বদলে রাজিয়া সুলতান মঞ্চস্থ হয়েছে প্রসেনিয়াম বা সম্মুখমঞ্চে। কলেজটির থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরাই অভিনয় করেছেন এতে। নির্দেশনা দিয়েছেন আতিকুল ইসলাম ও সৈয়দ মুহাম্মদ জুবায়ের। পালা নির্দেশনা প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, ‘গতানুগতিক যাত্রার অভিনয় থেকে সরে কিছুটা থিয়েট্রিক্যাল মঞ্চ ব্যবস্থাপনার দিকে গিয়েছি। এটা যাত্রার মৌলিক অভিনয়ের ধরন-চলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। অন্যদিকে যাত্রার সংলাপ প্রক্ষেপণ ও গীতিময়তাকে অটুট রাখা হয়েছে। চিরাচরিত পালার সঙ্গে একাডেমিক নাট্যচর্চার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে।’ আজও সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রয়েছে প্রদর্শনী।

এই অঞ্চলের প্রথম মুসলিম নারী সুলতান রাজিয়ার জীবন নিয়েই এই পালা। যুদ্ধক্ষেত্রে অবদান, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, প্রেম, সিংহাসনের সংকট নিয়ে পালার কাহিনি
ছবি: প্রথম আলো

পেশাদার যাত্রাশিল্পীদের কাছে এই নব আয়োজন কেমন লাগছে? যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মৃণাল কান্তি দে বলেন, ‘আমার ভালো লেগেছে। তরুণ শিক্ষার্থী, যারা বলতে গেলে কখনো গ্রামীণ যাত্রা দেখেনি, তাদের অভিনয় আমাকে অবাক করেছে। কয়েক বছর পর আমার যাত্রাজীবনের ৬০ পূর্ণ হবে। এই সময়ে নতুনদের এ পরিবেশনায় আমি মুগ্ধ।’ পাশাপাশি অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে মৃণাল কান্তি দে বলেন, ‘রচনা, সংলাপ, আলোক ব্যবস্থাপনা, অভিনয়—সবই ভালো। কিন্তু চারপাশ খোলা মঞ্চ হচ্ছে যাত্রার জন্য আদর্শ। ফলে যাত্রাপালার শিল্পীদের প্রবেশ-প্রস্থানের নিয়ম এখানে মানা হয়নি। যাত্রামঞ্চে অভিনয়ের যে সুযোগ, সেটা প্রসেনিয়াম মঞ্চে নেই। এটি সৌন্দর্য ও পারফরম্যান্সের জায়গা। সবচেয়ে বড় কথা, এই পালায় বিবেক নেই। বিবেকশূন্য যাত্রাপালা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা কি তবে বিবেকহীন হয়ে যাব?’

কলেজটির থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরাই অভিনয় করেছেন এ যাত্রাপালায়
ছবি: প্রথম আলো

পালাকার ও আয়োজক বিভাগের শিক্ষক জাহারাবী রিপন বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যবাহী যাত্রা থেকে প্রসেনিয়ামে এসেছি। সংলাপ, হাঁটা–চলায় যাত্রার ঢং রাখার চেষ্টা করেছি। একে আধুনিক করতে গিয়ে বিবেককে রাখা হয়নি। বিবেক গান গেয়ে মানুষকে সচকিত করে, আমরা বেশ কিছু নতুন গান রেখেছি। গ্রিক থিয়েটারে কোরাস ছিল, আধুনিক করার সময় এলিজাবেথিয়ান থিয়েটারে কোরাস বাদ দেওয়া হয়েছিল। আমরাও একইভাবে বিবেকের জন্য আলাদা গানের প্রয়োজন বোধ করিনি। বন্দনার মতো একটা নৃত্য রেখেছি, জলসার উৎসবে নাচের দৃশ্যে গান আছে। এগুলো নতুন ও মনোগ্রাহী। সব মিলিয়ে আমাদের পালায় যাত্রার স্বাদ ব্যাহত হয়নি।’ এই যাত্রাপালা নিয়ে আশাবাদী পালাকার। তিনি জানান, ঐতিহাসিক কাহিনির সঙ্গে ঐতিহাসিক পালার আবহে তাঁদের এই যাত্রাপালা নতুন সময়ের দর্শকদের টানবে। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে মৃণাল কান্তি দে বলেন, ‘একাডেমিশিয়ানদের সক্রিয়তা ও প্রযোজনায় প্রাচীন সাংস্কৃতিক এ ঐতিহ্য নাগরিক জীবনে প্রবেশ করল। যাদের গ্রামে গিয়ে যাত্রা দেখার সুযোগ নেই, তাদের ভেতর উৎসাহ তৈরি হবে।’

এ রকম নতুন যাত্রার তালিকায় রয়েছে শিল্পকলা একাডেমির ‘নিঃসঙ্গ লড়াই’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ‘বিসর্জন’, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও পরিবেশনাবিদ্যা বিভাগের ‘আপন ভাই’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জহুরনামা’ ইত্যাদি।