পাখিটি মরিল আমরা কি জাগিলাম?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রযোজিত নাটক তোতা কাহিনীর দৃশ্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রযোজিত নাটক তোতা কাহিনীর দৃশ্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘তোতা কাহিনী’তে তোতাপাখিটি মারা যায়। আর ইউসুফ হাসান অর্কর নির্দেশনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রযোজিত রবীন্দ্রনাথের ‘তোতা কাহিনী’ অবলম্বনে একই নামের নাটকের পরিণতিও এক—তোতাপাখির মর্মন্তুদ মৃত্যু। মাঝখানে এ নাটকের শরীরে স্থান নিয়েছে আমাদের সাম্প্রতিক শিক্ষাব্যবস্থার হালহকিকত ও সমকালীন নানা প্রসঙ্গ। কীভাবে? হ্যাঁ, সংক্ষেপে বলব সেই বৃত্তান্ত।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরীক্ষণ থিয়েটার হলের মঞ্চ। মঞ্চের পেছনে একটি নকশিকাঁথা। রাজদরবারের আবহে পাত্রপাত্রীরা বসে আছে দুই সারিতে। চলছে রাজার তোতাপাখিকে শিক্ষা দেওয়ার ভীষণ তোড়জোড়। পাখির জন্য খাঁচা তৈরি ও মেরামত, পাখি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজ্যের লোকলস্কর জোগাড়সহ এন্তেজাম বিরাট।
এদিকে পাখির শিক্ষা নিয়ে রাজবাড়িতে যত আয়োজন, যত কথা, সেসব ডিঙিয়ে বিপরীতধর্মী কথাও ভেসে ওঠে কোথাও কোথাও। নিন্দুকের এমন কথা শুনে একসময় রাজার খেয়াল হলো, কেমন শিক্ষা চলছে পাখির, তিনি স্বচক্ষে দেখবেন। হাঁক দিলেন তিনি মন্ত্রীকে, ‘কেমন শিক্ষা চলছে পাখিটির?’—রাজার সংলাপ।
মন্ত্রীর জবাব, ‘ভয়ংকর শিক্ষা, মহারাজ।’
‘ভয়ংকর শিক্ষা! শিক্ষা আবার ভয়ংকর হয় কীভাবে!’ মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন রাজা।

তোতা কাহিনী সেই ‘ভয়ংকর শিক্ষা’র টুকরো টুকরো চিত্র বারবার মেলে ধরেছে আমাদের সামনে। চেনা একটি গল্প প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে গোটা নাটক দেখছি আমরা। তো, সেই নাটকে দেখি, আমাদের জানা গল্পটি অনেক সময়ই থেমে যাচ্ছে। আর ওই স্থানজুড়ে বসছে সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সংগতিহীনতা। যেমন: নাটকের একপর্যায়ে দেখা যায়, মঞ্চজুড়ে বাংলা, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান, ইতিহাস—এমন নানা বইয়ের বোঝা নিয়ে ঘুরছে শিক্ষার্থীরা। কখনো আবার নাট্যকাহিনির ভেতরেই দেখতে পাচ্ছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং-বাণিজ্যের দৌরাত্মে৵র চিত্র, কিন্তু এতে মূল গল্পের আবেদন ক্ষুণ্ন হয় না মোটেও।

বাংলা বর্ণনাত্মক রীতি অনুসরণে দর্শকের সামনে নাটকটি মূর্ত হয়েছে গায়েন-দোহারের মাধ্যমে। ফলে গায়েনকে আমরা এখানে কখনো দেখি গায়েনের ভূমিকায়, আবার কখনো সে বদলে যায় নানারূপ চরিত্রে। আবার এই গায়েনই কখনো দর্শকের উদ্দেশে ছুড়ে দেয় তীক্ষ্ণধার প্রশ্ন। এভাবে দর্শকের সঙ্গে নাট্যকুশীলবের জীবন্ত যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে কাহি​িনতে তৈরি হয় নতুন নতুন মুহূর্ত।

এই নাট্যে যেমন বর্ণনাত্মক রীতির স্পর্শ পাই, তেমনি আছে বের্টল্ড ব্রেখট, আগস্ত বোয়াল—পশ্চিমের নাট্যতাত্ত্বিকদের ভাবনা-দর্শনের ছোঁয়াও। নাটকের আলো, সংগীত, মঞ্চ পরিকল্পনা—সর্বোপরি নাট্যনির্দেশনা সম্পর্কে বলতে গেলে এক কথায় বলতে হবে সবকিছুই এখানে ঝুঁকে আছে নিরাভরণতার দিকে। এ ক্ষেত্রে নির্দেশকের মুনশিয়ানা চোখ এড়ায় না। যদিও অভিনয়শিল্পীদের কারও কারও অভিনয় নিয়ে বলা যেতে পারে কথা—তর্ক উঠতে পারে নাটকের কোরাসগুলো ঠিকঠাক একসঙ্গে ধরা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও। কিন্তু খুঁটিনাটি বিচ্যুতি ছাপিয়ে নাটকটির যে অভীষ্ট, যে বক্তব্য, তোতা কাহিনী তার মঞ্চায়নের ভেতর দিয়ে সেখানে পৌঁছেছে নিঃসন্দেহে।

পাদটীকা: তোতা কাহিনীর শেষে মারা যায় তোতাপাখি। শেষ দৃশ্যে সুরের আবহে মঞ্চে বসে অভিনেতারা গেয়ে চলেছেন, ‘পাখিটি মরিল’। অন্যদিকে, আমরা যারা দর্শক, আমাদের হৃদয় কি তখন সিক্ত, পাখির মৃত্যুবেদনা কি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের? শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতিগুলো নিয়ে আমরা কি কথা বলব না এখনো?

নাটকে পাখিটি তো মরিল, আমরা কি জাগিলাম?