১৭০টি পেপার কাটিং থেকে ৮০টি রাখতে পেরেছি

শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে ছিল কাজল ইব্রাহিমের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান

পাঁচ বছর বয়সে বুলবুল একাডেমিতে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করেন কাজল মাহমুদ। গানের ক্লাসের ফাঁকে প্রায়ই উঠে গিয়ে উঁকি দিতেন নাচের ক্লাসে। তখন সেখানে নাচ শেখাতেন জি এ মান্নান ও রাহিজা খানম ঝুনু। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁদের দেখে অনুকরণের চেষ্টাও করতেন কাজল। একদিন সেটা দেখে ফেলেন ডালিয়া নিলুফার, ঝুনু আর লায়লা হাসান। তাঁরা ছোট্ট কাজলকে কোলে নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, ‘খালা, আপনি ওকে নাচে দেন।’ কাজলের মায়ের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে গান শেখাবেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহের কথা জেনে ভর্তি করিয়ে দিলেন নাচে।

১৯৫৯-৬০ সালে জি এ মান্নানের কাছে কাজলের নাচে হাতেখড়ি। একসময় তিনি কত্থক নাচে ভর্তি হন। কত্থকগুরু সমর ভট্টাচার্য সপ্তাহে দুই দিন বাড়িতে গিয়ে নাচ শেখাতেন। কাজল বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১৫। রোজি আপার (লায়লা হাসান) “চিত্রাঙ্গদা” করার কথা ছিল। কোন কারণে তিনি করতে পারলেন না। ঝুনু আপাও করলেন না। তখন আতিক (আতিকুল ইসলাম) ভাই আমাকে বললেন, তুমি একবার করে দেখাও। আমি তখন “আমার অঙ্গে অঙ্গে যে বাজায় বাঁশী” গানটাতে নেচে দেখালাম। আমাকে সিলেক্ট করা হলো। আমি ভাবতেও পারিনি এত তাড়াতাড়ি আমাকে কত্থক থেকে রবীন্দ্রনৃত্যে সুযোগ দেওয়া হবে। তখন চিত্রাঙ্গদার কুরূপা ও সুরূপা দুটো চরিত্র আমি একাই করলাম। ওই “চিত্রাঙ্গদা” দেখেই আমার বর তারেক ইব্রাহীম আমাকে পছন্দ করেন। তার ৯ বছর পর আমরা বিয়ে করে সংসার শুরু করি। বিয়ের পর আমার নাম হলো কাজল ইব্রাহীম।’

গত শতকের ষাট থেকে আশির দশক মাঝামাঝি নৃত্যমঞ্চে সরব ছিলেন কাজল ইব্রাহিম। ১৯৭৫ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নৃত্যশিল্পী, বয়স তখন ২২ বছর। সেই কাজল একদিন খুলে ফেললেন ঘুঙুর, ছেড়ে দিলেন নাচ। কী ঘটেছিল তাঁর জীবনে! সেসবের কিছুটা জানা যাবে ‘নৃত্যে গাঁথা কথামালা’য়। স্মৃতিচারণমূলক বইটি লিখেছেন নৃত্যশিল্পী কাজল ইব্রাহিম।

কাজল ইব্রাহিমের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আয়োজক নৃত্যাঞ্চলের শিবলী মহম্মদ ও শামীম আরা নীপা
ছবি: সংগৃহীত

গতকাল শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হলো। নৃত্যাঞ্চল আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা। নিজের বই প্রসঙ্গে কাজল ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৃত্যজীবনে বহু গল্প আছে। সবটা একটি বইতে ধরে রাখা কঠিন। মা আমার হাতে একটা অ্যালবাম তুলে দিয়েছিলেন। তাতে ১৭০টি পেপার কাটিং ছিল। সেখান থেকে ৮০টি আমি এই বইতে রাখতে পেরেছি।’

৩৫ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে জীবনালেখ্য ‘মীরা’ দিয়ে আবারও মঞ্চে ফিরেছেন কাজল ইব্রাহিম। বিরতি প্রসঙ্গে কাজল ইব্রাহিম বলেন, ‘ছেলেমেয়েকে বড় করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে আমার এখন প্রথম কাজ হচ্ছে তাদের বড় করা। এ জন্য মঞ্চ বা টিভিতে পারফর্ম করতে পারিনি। টিভিতে শেষ অনুষ্ঠান করেছিলাম আমার ছেলের বয়স যখন ছয় মাস। প্রোগ্রামটা করার পর নিজেকে দেখে মনে হলো, বেশ মুটিয়ে গেছি। তখনই ভাবলাম, আমার এখানেই ইতি টানা উচিত। আজ বুঝি, সেটা ছিল আমার ভুল সিদ্ধান্ত।’

কাজল ইব্রাহিম
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রিয়ভাজন নৃত্যশিল্পীরা বারবার তাঁকে মঞ্চে ডেকেছেন। নতুন করে শুরু করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মা বিটিভির সাবেক প্রযোজক বদরুন্নেসা আবদুল্লাহর জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা কাজের প্রস্তাব পাই। আমার পূর্বপরিচিত কানাডা প্রবাসী ভারতীয় কোরিওগ্রাফার সুকল্যাণ ভট্টাচার্য বলল, “দিদি তুমি নাচ নিয়ে কিছু একটা কর।” আমাকে দিয়ে সে “চণ্ডালিকা” করাতে চেয়েছিল। যেখানে আমি চণ্ডালিকার মা, আর (শামীম আরা) নীপা চণ্ডালিকা করবে। কলকাতায় সুকল্যাণ আবারও সে প্রসঙ্গ তুলল। যখন সে মীরার গল্পটা আমাকে শোনাল, মনে হলো, এই বয়সে আমি সেটাই করতে পারি। মীরার যে আধ্যাত্মিক প্রেম, সেটাকে ভালোবেসে, সেটার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি সেই চরিত্রটা করতে পারি। ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি “মীরা”য় কাজ করব। আবার মঞ্চে ফিরব, নাচে ফিরব।’