জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটারে থিয়েট্রেক্স প্রযোজিত নাট্যকার সেলিম আল দীনের ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় গতকাল
ছবি: সুদীপ চক্রবর্তী

লন্ডনের গোল্ডস্মিথস্ ইউনিভার্সিটি থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগের মাস্টার্স পাঠ্যসূচিতে ২০২১ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখা নাটক ‘স্বর্ণবোয়াল’। নাটকটির প্রধান চরিত্র এক বিশাল মাছ, যার নাম ‘স্বর্ণবোয়াল’। বলা হয়, ‘মাছ’ নিয়ে বাংলায় এটিই প্রথম নাটক। বহু বছর পর গতকাল ঢাকার মঞ্চে দেখা গেল নাটকটি। ব্রিটিশ কাউন্সিল ও মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নাটকটি প্রযোজনা করেছে থিয়েট্রেক্স বাংলাদেশ। নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী।

শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেশ জমজমাট ছিল সংস্কৃতি–অঙ্গন। গান, নাচ, নাটকসহ বিচিত্র আয়োজন ছিল নানা মঞ্চে। এর মধ্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে পরীক্ষণ থিয়েটারের ‘স্বর্ণবোয়াল’। ঠিক এক দশক আগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য-স্নাতকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘থিয়েট্রেক্স বাংলাদেশ’। এক দশক উদ্‌যাপনের মুহূর্তে তাদের এবারের নিবেদন সেলিম আল দীনের এই নাটক। ১১৭ জন নেপথ্য ও মঞ্চ কুশীলব অংশ নিয়েছেন এই প্রযোজনায়। নাটকের শুরুতে ছিলেন বরেণ্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, শেষে ওয়াহীদা মল্লিকের উপস্থিতি। তাঁরা ছিলেন কথকের ভূমিকায়।

‘স্বর্ণবোয়াল’-এর প্রধান চরিত্র মাছ; চকচকে সোনার রং তার। সবাই তাকে দেখতেও পায় না। মাছটি শিকারের নেশায় জীবন দেয় জনম মাঝি ও খলিশা মাঝি। ৬০ বছর বয়সে কোশা নৌকায় বসে জনম মাঝি এক ভোরে ছিপ ফেলে বড়শিতে গেঁথেছিল মাছটিকে। কিন্তু ছোট্ট কোশাসহ মাছটি তাকে টেনে নেয় গভীর জলে। জনম মাঝির স্বর্ণবোয়াল শিকারের নেশা সংক্রমিত হয় ছেলে খলিশার শরীরে, কিন্তু সেও পারে না মাছটি শিকার করতে। তার ছেলে তিরমন অজেয় মাছটিকে জয় করতে পারবে, এমন স্বপ্ন দেখে। বাবার কাছে মাছটির গল্প শুনতে শুনতে তিরমনের ভেতরও শিকারের নেশা জাগে।

মৃতপ্রায় বাবাকে রেখে মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে ভাদ্র মাসের এক ঝড়ের রাতে বড়শি নিয়ে সে যাত্রা করে স্বর্ণবোয়াল শিকারে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর বোয়ালটিকে ধরেও ফেলে। তবে নদীতীরে টেনে আনতে পারলেও শেষ পর্যন্ত মাছটি লাফ দিয়ে গভীর জলে চলে যায়। অজেয় মাছ অজেয়ই থেকে যায়। নাটক শেষে দেখানো হয়, স্বর্ণবোয়ালও হারেনি, তিরমনও হারেনি অথবা দুজনের কেউ-ই জেতেনি। হারজিতহীন এই দর্শন নিয়েই ‘স্বর্ণবোয়াল’।

‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকের দৃশ্য

‘স্বর্ণবোয়াল’ নিয়ে নিয়মিত মহড়া করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। প্রদর্শনীর আগে মহড়ায় অংশ নেন গতকালও। শরীর কিঞ্চিৎ অসুস্থ, তারপরও মঞ্চের প্রতি ভালোবাসার টানে হাজির হন। এটি তাঁর কাছে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, লোককাহিনি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, লোকজ বিষয়বস্তু নিয়ে কাব্যিক ভাষায় লেখা এ নাটক। যেখানে ঘুরেফিরে খাদ্য বা স্বপ্নের জন্য মানুষের জীবনের সংগ্রাম কাব্যিক রূপে এসেছে। রূপকের আড়ালে মানুষের জীবনভর সাধনা-সংগ্রামের গল্প বলেছেন নাট্যকার। যে গল্পে জন্ম হওয়ার পরই মানুষ জীবনভর এমন এক স্বর্ণবোয়ালের পেছনে ছুটেই জীবন সায়াহ্নে পৌঁছায়।

২০০৬ সালে সেলিম আল দীনের একান্ত সচিব হিসেবে পাশে ছিলেন লেখক স্বকৃত নোমান। স্মৃতিচারণা করে তিনি জানান, সেলিম আল দীন যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, অধ্যাপক শামসুল হক প্রায়ই সেলিম আল দীনকে তাঁর মাছ শিকারের বিচিত্র সব কাহিনি শোনাতেন। তখন থেকেই মূলত মাছ নিয়ে কিছু একটা লেখার কথা ভাবতে শুরু করলেন সেলিম আল দীন। এমনিতে তিনি মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই নয়ারহাট বাজার থেকে একটি মাছ কিনলেন তিনি, যেটির গায়ের রং সোনার মতো চকচকে, হলদে। সেই সূত্রে তাঁর কল্পনার চোখে বাজার থেকে কেনা সেই স্বর্ণবরন বোয়াল মাছটি দ্যুতির সজীবতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল একদিন। এ ঘটনার কয়েক দিন পরই তিনি ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকটি লিখতে শুরু করেন।

১৯৫৬ সালে কার্জন হলে প্রথম প্রকাশ্য প্রদর্শনী হয়েছিল মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটির। তার দীর্ঘ ছয় দশক পর ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে কবর-এর দর্শক প্রদর্শনী করে থিয়েট্রেক্স। আর ১০ বছর আগে ‘কবর’ নাটক নিয়ে যাত্রা শুরু করে থিয়েট্রেক্স। দলটির দ্বিতীয় প্রযোজনা শাহমান মৈশানের ‘দক্ষিণা সুন্দরী’। নাটকটি ২০১৪ সালে কমনওয়েলথ গেমস নাট্যোৎসবে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়।

ছবি: সুদীপ চক্রবর্তী

তৃতীয় নাটক আতিকুল ইসলাম রচিত ও নির্দেশিত ‘মা, মাটি ও দেশ’। ‘স্বর্ণবোয়াল’ তাদের চতুর্থ প্রযোজনা। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন মাহজাবীন ইসলাম, সৈয়দ মেহেদী হাসান, রুদ্র সাঁওজাল, সায়েমা আক্তার, মোর্শেদ মিয়া, রাব্বী মিয়া, রাউফুর রহিম, তিথী চক্রবর্তী। নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে জানালেন, দীর্ঘ ১০ বছর নাটকটি নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ১০ বছরের ভাবনা ও গবেষণার পর নাটকটি দর্শকের সামনে মঞ্চায়ন করতে পারার পেছনে শতাধিক মানুষের অবদান রয়েছে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি জানান, এখন থেকে নাটকটির নিয়মিত প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে তাঁদের।

আরও পড়ুন

'মন্ত্রাসের মত নাটক প্রচণ্ড চাপ ফেলে'