গোদাগাড়ীতে জমেছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫০ দলের সাংস্কৃতিক মেলা
‘নেসলে গোইয়া ঝুমলে গোয়া’ ওঁরাও ভাষার এই বিয়ের গীতে বেহাইকে নাচতে ও ঝিমাতে বলা হচ্ছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সাকুড়া গ্রামের ওঁরাও সম্প্রদায়ের একদল নারী নেচে নেচে এই গীত গাইছে। এভাবে শুক্র ও শনিবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী নৃত্য-গীত পরিবেশন করা হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও মেলায়। উপজেলার কাদমা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দুই দিনব্যাপী এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও মেলার আয়োজন করেছে ‘রক্ষা গোলা সমন্বয় কমিটি’। এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রক্ষাগোলা গ্রাম সমাজ সংগঠনসমূহের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও মেলা।’
সিসিবিভিও নামের বেসরকারি সংস্থা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫০টি গ্রামের জনজাতিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য রক্ষা গোলা খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ করছে।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে শনিবার বিকেলে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সিসিবিভিওর সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সালাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের দক্ষিণ এশিয়ার সমন্বয়কারী পামেলা, ভারত থেকে আগত অতিথি রান্ধির সিং, এমডিএফের পরামর্শক মাহবুবা হক, সিসিবিভিওর সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাহী প্রধান রক্ষাগোলা মডেলের গবেষক সারওয়ার ই কামাল স্বপন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমির গবেষক বেঞ্জামিন টুডু ও কাদমা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম গোলাম মোস্তফা।
মেলার আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি বলেন, ‘আদিবাসীদের সংস্কৃতির তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাল–ছন্দ আর যূথবদ্ধতা। এই বৈশিষ্ট্য তাদের একতাবদ্ধ থাকার প্রেরণা। তারা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতা তাদের সবচেয়ে বেশি। সভ্যতার নব নব আবিষ্কার বা উন্মেষের সঙ্গে এরা যেতে পারছে না। দূরে দূরে থাকছে। এদের এটা একটা প্রবণতা। গাদাবন্দুক আবিষ্কার হয়েছিল ১১০০ বছর আগে, তারপরে এই আধুনিক সভ্যতাই ডিনামাইট আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু আদিবাসীরা সেই প্রস্তরযুগের তির–ধনুক নিয়েই আছে। এরা জঙ্গলকে পরিষ্কার করে জমিকে চাষযোগ্য করেছে। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানের আয়োজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে এই জনজাতির মানুষকে আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত করা। তারা যদি এই জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে, বিকশিত হতে পারে, হারিয়ে না যায়।
সারোয়ার ই কামাল বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যে নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, তাঁরা জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলান এবং কাজ শেষে তাঁদের সাংস্কৃতিক উৎসবে তাঁরা মেতে ওঠেন। কিন্তু দিনে দিনে তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছেন, তাঁদের ভাষা হারিয়ে ফেলছেন। আমরা কাজ করছি, তাঁরা যেন তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ পান এবং নিজে নিজের সংস্কৃতির মাধ্যমে আত্মপরিচয় দিতে পারেন।’
শিয়ালডাং গ্রাম থেকে ইমেলাই এসেছেন বর্ণালী হাসদা।
তিনি নাচে অংশগ্রহণ করেছেন। সাঁওতালি ভাষায় তাঁদের গীতের প্রথম লাইন ছিল, ‘কুরুপ চেহ ঝিগো নাড়ি। পশ্চিম চেহ ঝিগো নাড়ি রে দাদা গোয়ে ঝুলিয়ে।’ এই গানের অর্থ হচ্ছে যে উত্তর দিকে ঝিঙের কাজ, পশ্চিম দিকেও ঝিঙের গাছ। গাছে গরু আটকে গেছে। উত্তরে দাদা বলবে গরুকে মেরো না গাছের লতাপাতাই কেটে দাও। সাঁওতাল কিশোর বৃষ্টি মডি এ মেলায় দুবার এসেছে। সে নাচে অংশ নিতে পারেনি। তার খালারা নাচে অংশ নিয়েছে। সে দেখেছে খুব মজা পেয়েছে।
সাকুড়া গ্রাম থেকে এসেছেন মামুনি লাকড়া ও পদ্মাবতী টপ্পো। তাঁরা দুজনই নাচে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নাচের পোশাক পরে মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের দলে আটজন নৃত্য পরিবেশন করেছেন। তাঁরা বলেন, বাড়িতেও বিয়ের সময় এই নৃত্য ও গীত তাঁরা করে থাকেন। মেলা থেকে পদ্মাবতী কিনেছেন শিশুদের ছবি আর মামুনি যাওয়ার সময় বাচ্চাদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন। মামুনি তাঁর নিজের ভাষায় বললেন, ‘এ মেলা নে আইকে হামকে খুব ভালো লাগাথে।’ বাংলা এর অর্থ হচ্ছে মেলায় এসে খুব ভালো লেগেছে।
মেলার স্টাইলগুলো ভিন্ন জনজাতির নিজস্ব সংস্কৃতির তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। এখানে গরুর গাড়ি থেকে শুরু করে রয়েছে ধানমাড়াই করার জিনিসপত্র, ধান চাষের লাঙল–জোয়াল, শিকারের তির–ধনুকসহ যা তাঁদের আত্মপরিচয় তুলে ধরছে।
রায় ও রাজোয়াড়দের স্টলে দেখা গেল অর্পিতা রানী নামে একটা ছোট্ট শিশু চোখে কাজল দিচ্ছে, তার পেছনে আরেকটা মেয়ে খোঁপায় ফুল গুঁজে নিচ্ছে। টেবিলের ওপরে মাদল ও তাদের নিজস্ব জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
মুন্ডা ও গরাইৎ জনজাতির মেয়েরা তদের স্টলে কলাগাছ দিয়ে সুন্দর কৃষির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। তাদের জিনিসপত্রের সঙ্গে টেবিলে আছে হারমোনিয়াম, কৃষিসামগ্রী ও নিজেদের পরিচয় বহন করে, এমন সব জিনিসপত্র। ভেতরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে পার্ক খোঁপা ঠিক করে নিচ্ছে।
শেষ সময়ে মনে হলো, মাঠজুড়ে এই মেলার আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। রঙিন পোশাক পরা আর খোঁপায় ফুল গোজা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন, তাঁরা হাসাহাসি করছেন। বিদায় নেওয়ার সময় তাঁরা নিজ নিজ স্টলের কাছে এসে আরেকবার মনের আনন্দে নাচে–গানে মেতে উঠছেন। পরমেশ্বর নামের এক বৃদ্ধ অনুষ্ঠানে মাদল বাজিয়েছেন, তাঁর আনন্দ যেন থামছে না। শেষ সময়ে স্টলে এসে শেষ বাজনা বাজিয়ে নিচ্ছেন।