ঈদের ছুটিতে ‘কম্পানি’তে মজেছে নাটকপাড়া

‘কম্পানি’ নাটকের শেষ দৃশ্যমাসুম আলী

ঈদের ছুটিতে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে উৎসবের আমেজ। শুক্রবার সন্ধ্যা। নানা বয়সের মানুষ ইতিউতি আড্ডা; গল্পে মশগুল সবাই। সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনের বেল বাজতেই অনেকে লাইন ধরলেন। মুহূর্তের মধ্যে পাশাপাশি দুটি বড় লাইন। খেয়াল করে দেখলাম, অনেকে পরেছেন নতুন পোশাক। তাঁদের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। কেননা ঈদের বড় ছুটিতে অনেকেই যখন সেজেগুজে আত্মীয়, বন্ধুর বাড়ি বেড়াচ্ছেন, কেউবা ছুটির অবকাশে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন সময় কাটাতে, কেউ ঢুঁ মারছেন সিনেমা হলে। সেখানে এই মানুষগুলো এসেছেন নতুন নাটক পাড়ায়, ঈদের আনন্দ খুঁজতে।

‘এই ঈদে আপনার আনন্দের উৎস হোক মঞ্চনাটক’ স্লোগানে ঈদের দিন সন্ধ্যা সাতটায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে হয় ‘কম্পানি’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী। শুক্রবার সন্ধ্যায় ছিল দ্বিতীয় প্রদর্শনী।

দৌলত খাঁ চরিত্রে আরিফ হোসেন এবং সিরাজউদ্দৌল্লা চরিত্রে সাজ্জাদ সাজু,
প্রথম আলো

নাটক শুরুর আগে মঞ্চের নেপথ্যে ঘোষণা আসে; চেনা কণ্ঠ, বরেণ্য মামুনুর রশীদ জানালেন নাটকের পটভূমি। ১৭৪৩–১৭৪৪ সালে; ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টি থেকে শুরু। ইউরোপীয়দের ভারতবর্ষে আসার ফলে এ অঞ্চলের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরু। ভারতবর্ষে এসেই তারা বাজার ও ভূখণ্ড দখলের প্রতিযোগিতায় নামে।

তাদের পক্ষে-বিপক্ষে থাকে এ অঞ্চলের সামন্তরা। একপর্যায়ে এই ভূখণ্ড পরিণত হয় ব্রিটিশ উপনিবেশে। মানুষের জীবনচর্চায় ব্রিটিশরা যে আধুনিকতার সূচনা করে, তাকে ম্লান করে দিয়েছে তাদেরই শোষণ, লুণ্ঠন ও পাচারের ইতিহাস। নিজেদের লুণ্ঠনের শাসননীতি অক্ষুণ্ন রাখতে তারা ধর্মে–বর্ণে-গোত্রে-জাতিতে বিরোধ বাধিয়ে রেখেছিল। এই বিরোধ ও বিভক্তির পথ ধরেই বাংলায় শেষ হয়েছে স্বাধীন নবাবি শাসনের। যার অন্যতম নেপথ্য খল নায়ক রবার্ট ক্লাইভ।
২৫০ বছরের বেশি পুরোনো সে ইতিহাস। সংলাপ, আলো, সংগীতে দর্শক ফিরলেন সেই সময়ে। মাঝে ১০ মিনিটের বিরতি। আগে–পরের পুরো সময়ে মিলনায়তনে ছিল আক্ষরিক অর্থে পিনপতন নীরবতা। আনুমানিক ৯০ শতাংশ পূর্ণ মিলনায়তনের একটা দর্শক আসন ছেড়ে যাননি। মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন গল্পের ভেতরে নানা মারপ্যাঁচ ও কূটচাল। সংঘাত। যুদ্ধের ময়দানে নয়; বরং মূলত ষড়যন্ত্র, কূটচাল আর নিকটজনের বিশ্বাসঘাতকতায় পাড়ার মাস্তান রবার্ট ক্লাইভের কাছে পরাজিত হতে হয় অপরিণত বয়সী বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা। বিনোদনের ফাঁকে ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদন—নাটক দেখে এমনটাই মনে হয়েছে।

ঈদের দিন সন্ধ্যা সাতটায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে হয় ‘কম্পানি’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী
মাসুম আলী

ইতিহাস আর বিনোদনের মিশেলে নাটক বলে যায় অনেক কথা। সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যার পর অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীন শাসনের সূর্যের। লুট হয়ে যায় বাংলার অবশিষ্ট সম্পদ। কালের পরিক্রমায় ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। তবু আজ আড়াই শ বছরের বেশি সময় পরও বাংলায় অব্যাহত রয়েছে সেই লুণ্ঠন ও অর্থ পাচারের চিত্র।

দর্শক প্রশ্নের মুখোমুখি হন, কারা করছে এই লুণ্ঠন? তারা কি একেকজন নব্য রবার্ট ক্লাইভ?
নাটকের শেষ দৃশ্যে রীতিমতো চমক দিয়ে মঞ্চে আসেন মামুনুর রশীদ। তাঁর সেলিম রহমানের চরিত্রটি অনেক শিল্পপতি, বিত্তশালীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মঞ্চে মামুনুর রশীদের উপস্থিতিতে দর্শকও নড়েচড়ে বসে। তুমুল করতালি। উপস্থাপক বলে যান, আমাদের বাংলার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্রকে স্মরণ রাখার জন্য বহু পাউন্ড, স্টার্লিং, ডলার ব্যয় করে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় এই ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। সেই ভাস্কর্য উন্মোচন করবেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নাগরিক সেলিম রহমান...। সেলিম রহমান হাসিমুখ নিয়ে বলতে থাকেন, লর্ড রবার্ট ক্লাইভ আমাদের জাতীয় জীবনের এক অন্যতম বীর। তিনি লুণ্ঠনকে একটি শিল্প শুধু নয়, ইংরেজি ডিকশনারিতে একটি নতুন শব্দ যোগ করে গেছেন ‘লুট’। লুট উর্দু শব্দ, তাঁর কারণেই লুট জায়গা পেয়েছে বাংলায়, ইংরেজিতে। আরেকটি হলো তিনি সম্পদ লুট করে তা কীভাবে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায়, তা শিখিয়েছেন। তাঁর মেধার এই সর্বোচ্চ ব্যবহার আমাদের পথ দেখিয়েছে। আমরাও দেশের সম্পদকে আভিজাত্য দিয়েছি। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের সম্পদ—সেখানে পাড়া–মহল্লা নির্মাণ করছি...।’ নেপথ্যে গান ভেসে আসে—লুট লিয়া গো লুট লিয়া...।

অনেক ভাষার ব্যবহার আছে নাটকে। নির্দেশক জানালেন, নাটকের প্রয়োজনে শিল্পীরা ফারসি, উর্দু ভাষা, বর্ণ শিখেছেন। সঠিক উচ্চারণ, সুরে ফারসি গান গাওয়ার চেষ্টা করছেন।

নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন মঞ্চে। ছোট-বড় সব চরিত্রেই ছিলেন প্রাণবন্ত। বিশেষ করে মির জাফর চরিত্রে সুজাত শিমুল, ক্লাইভ চরিত্রে শাহারান, সিরাজউদ্দৌল্লা চরিত্রে সাজ্জাদ সাজু, দৌলত খাঁ চরিত্রে আরিফ হোসেন, জহরত বাই চরিত্রে রুবলী চৌধুরী আলো কেড়েছেন।

নাটকের একটি দৃশ্য
প্রথম আলো

দর্শকের করতালি, অভিনন্দন নিয়ে গ্রিনরুমে ফিরে যান সব শিল্পী। গ্রিনরুমে কথা হয় নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঈদ উৎসবে গান, চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজ—প্রায় সব ক্ষেত্রই রমরমা থাকলেও ব্যতিক্রম ছিল মঞ্চনাট্যাঙ্গন। ধীরে ধীরে সে চিত্র পাল্টাচ্ছে। বড় ছুটির কারণে আমরা কিছুটা হলেও চিন্তায় ছিলাম দর্শকের উপস্থিতি নিয়ে। কিন্তু আমাদের অবাক করেই দর্শক সাড়া দিয়েছে। ঈদের দিন সন্ধ্যায় দর্শক প্রায় পরিপূর্ণ ছিল। আজ শুক্রবার দ্বিতীয় দিনেও তা–ই। আমরা দর্শকের কাছে কৃতজ্ঞ।’
আজ বাংলা বর্ষ ১৪৩০–এর শেষ দিনে রয়েছে ‘কম্পানি’ নাটকের তৃতীয় শো। কাল রোববার ১ বৈশাখ রয়েছে চতুর্থ ও শেষ প্রদর্শনী। ছুটিতে সময় করে দেখে নিতে পারেন ঢাকার মঞ্চে নতুন এই সংযোজন; সময়টা বৃথা যাবে না।