আজ আসছে বটতলার ‘যোজনগন্ধা মায়া’

চলছে মহড়া। ছবি: বটতলার সৌজন্যে

নতুন প্রযোজনা যোজনগন্ধা মায়া নিয়ে আসছে বটতলা নাট্যদল। জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হবে। একই স্থানে আগামীকাল বিকেল পাঁচটা ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রয়েছে নাটকটির আরও দুটি প্রদর্শনী। বদরুজ্জামান আলমগীরের লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ইমরান খান।
নাটকটির গল্প প্রসঙ্গে নির্দেশক বলেন, যোজনগন্ধা মায়ার পটভূমি লতিপুতি গ্রাম। কুমিরপীরের মাজার ঘিরে আবর্তিত হয় এখানকার মানুষের জীবন। কুমিরপীর কৃষকের ভাতের অধিকার ও মানুষকে নিজের অধিকার চিনে নিতে শেখান। মানুষের ‘চোখের ঠুলি’ খুলে দিতে চাওয়ার অপরাধে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। তবে মৃত্যুর পরও তিনি মানুষের সাহস ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে থাকেন। পীরের রেখে যাওয়া বাণীর বাহক হয়ে ওঠে কুরুমণি।

জমির অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সে একসময় নিজের সন্তান জহরকে যুদ্ধে পাঠায়। এর পর থেকেই হারানো সন্তানের অপেক্ষায় কাটতে থাকে কুরুমণির জীবন। এই অপেক্ষার মধ্যেই এক সকালে গ্রামে হাজির হয় আলফ্রেড পাহান—অধিকার ও মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠা একটি চরিত্র। কুরুমণি ও গ্রামের মানুষের আশায় প্রতীক হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত জহরের মতোই আর ফিরে আসে না পাহান। মানুষের আয়ুর শেষ থাকলেও অপেক্ষার শেষ নেই—এই উপলব্ধিই নাটকটির কেন্দ্রীয় ভাবনা। নাটকের ঘটনাপ্রবাহ মুক্তিযুদ্ধ, শূন্য দশক এবং তার প্রায় ১২০ বছর আগের অতীতের মধ্যে অনায়াসে যাতায়াত করে। নির্দিষ্ট কোনো সময়ের নয়, যোজনগন্ধা মায়া এক আবহমান কালের গল্প ।

মহড়াকালে যোজনগন্ধা মায়া নাটকের একটি মুহূর্ত। ছবি: বটতলার সৌজন্যে

বাঘ ও মহিষের অনন্ত লড়াইয়ের মতোই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের ভেতরে যুগে যুগে থেকে গেছে; সেই চিরন্তন ট্র্যাজিক বাস্তবতারই মঞ্চরূপ এই নাটক।
নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে গতকাল বুধবার সকালে হোয়াটসঅ্যাপ আলাপচারিতায় তিনি জানান, যোজনগন্ধা মায়া লিখেছিলেন কয়েক বছর আগে, অনেকটাই একধরনের ঘোরের ভেতর থেকে।

তাঁর ভাষায়, ‘এই লেখার ভেতরে দূরত্ব ও নৈকট্যের এক অদ্ভুত মায়া কাজ করেছে, সেখান থেকেই নাটকের নাম ও তার কেন্দ্রীয় আকুতির বিন্যাস।’ তিনি বলেন, ইতিহাসের নানা বাঁকে ১৯৭১-কে স্থির করে রাখার চেষ্টা হলেও মানুষের স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষাকে বেঁধে রাখা যায় না। নাট্যকারের মতে, ‘অপেক্ষা’ একটি গভীর মানবিক মানদণ্ড। কোনো জনপদের সভ্যতা বোঝা যায় তারা মৃতদের কতটা সম্মান করে এবং কতটা গভীরভাবে অপেক্ষা করতে পারে, তার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, প্রতিটি লড়াই শেষে রাজনীতিবিদরা করমর্দনে ব্যস্ত থাকে, ধনীরা বাজারে দাম বাড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতির উশুল তোলে, আর প্রান্তিক মানুষ খুঁজে ফেরে যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কবর। যোজনগন্ধা মায়া মূলত সেই খোঁজাখুঁজির গল্প—অপেক্ষা, বেদনা ও অসমাপ্ত স্বপ্নের আখ্যান।

মহড়াকালে যোজনগন্ধা মায়া নাটকের একটি মুহূর্ত। ছবি: বটতলার সৌজন্যে

নির্দেশক ইমরান খান বলেন, ‘২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় অগ্রজ সামিনা লুৎফার মাধ্যমে যোজনগন্ধা মায়ার খোঁজ পাই।’ তাঁর ভাষায়, এই নাটকে একটা অদ্ভুত বেদনার রং আছে, মা যেমন সন্তানের অপেক্ষায় থাকে, তেমনি একটি জনপদ মুক্তির অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সেই মুক্তি কি কখনোই আসে? তিনি আরও বলেন, ‘ফিলিস্তিন থেকে এই বাংলা—স্বাধীনতার জন্য লেখা অধ্যায়গুলো আমাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য একজন মায়ের অপেক্ষাই আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে।’

ইমরান খান জানান, নাটকটির উপস্থাপনায় তিনি দেশীয় রীতির সঙ্গে কিছুটা মধ্য এশীয় ফর্মের সংমিশ্রণ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘অলৌকিকতার স্তরে আমি বারবার গেছি, কিন্তু তার ব্যাখ্যা দিতে চাইনি। দর্শক নিজের মতো করে বয়ান তৈরি করবেন।’
নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সামিনা লুৎফা, মোহাম্মদ আলী হায়দার, কাজী রোকসানা, গোলাম মাহবুব, মনিরা খাতুন, মুন ইসলাম, নিরঞ্জন দাস, আশরাফুল ইসলাম, শাহাদত হোসেন প্রমুখ। সুর ও সংগীত পরিকল্পনায় রয়েছেন পলাশ নাথ ও চন্দ্রাবতী ইভা, পোশাক পরিকল্পনায় মহসিনা আক্তার এবং আলোক পরিকল্পনায় ধীমানচন্দ্র বর্মন।
যোজনগন্ধা মায়া বটতলা নাট্যদলের ২৫তম প্রযোজনা। ২০২৩ সালে মঞ্চে এনেছিল সখী রঙ্গমালা।