‘যেন দেখলেই বুঝতে পারে, আমরা বাংলাদেশের’

পূজা সেনগুপ্ত। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
কড়াইলের সুবিধাবঞ্চিত ৩৩টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাচ শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছেন নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত। গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া নাচের এই ক্লাস চলবে আগামী মার্চ পর্যন্ত। গতকাল মুঠোফোনে বিনোদনের সঙ্গে আলাপে নাচ নিয়ে তাঁর উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানালেন এই নৃত্যশিল্পী

৩১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম নাচের রেপার্টরি তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার। এক দশকের সাফল্য উদ্‌যাপনের উপলক্ষে নানা আয়োজন করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে রাজধানীর কড়াইল এলাকার বাচ্চাদের জন্য পূজা সেনগুপ্তর নাচের ক্লাস ‘নয়নতারা’র ৩৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। এই শিশুদের সবাই সুবিধাবঞ্চিত।

পূজা সেনগুপ্ত। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

এ আয়োজন নিয়ে সংগঠনটির প্রধান পূজা বলেন, ‘“নয়নতারা” তুরঙ্গমীর একটি পেশাদার নাচের ক্লাস। যেখানে শিক্ষার্থীদের নাচের পাশাপাশি স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম, পিলাটেস শেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও যোগাযোগে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন। প্রথাগত নাচ শেখানোর পাশাপাশি থাকছে নাচের ইতিহাস, দেশ-বিদেশের নাচের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ, যা শিশুদের বিকাশে সহযোগিতা করবে।’

১০ বছরে প্রাপ্তি
শুরু থেকে সময়টা কঠিন ছিল। তবে যে লক্ষ্য নিয়ে শুরু, সেটার অনেকটাই পূরণ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের বাইরে একাধিক উৎসবে নাচের দল নিয়ে অংশ নিয়েছেন পূজা। তাঁদের পারফর্ম করা সেই ভিডিওগুলোও ভাইরাল হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজের নাচের দল নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে পূজা জানান, তাঁদের ১০ জনের একটি দল ড্যান্স প্যারেডে অংশ নিয়েছিল। সেখানে তাঁদের নাচ আলাদাভাবে দর্শকদের আকৃষ্ট করে।

পূজা সেনগুপ্ত। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে সব সময় চেয়েছি নিজেদের আলাদা করে তুলে ধরতে। সেটাই হয়েছে। আমাদের যত নৃত্যশিল্পী রয়েছেন, সবাই এখন নাচকেই পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। আমাদের দল পেশাদারভাবেই কাজ করছে। আমরা বাণিজ্যিকভাবে সফল। আমরা যেখানে শো করছি, সেখানেই বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছি। আলাদা দর্শক তৈরি আমাদের বড় প্রাপ্তি।’

প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়া
একটা প্রত্যাশা নিয়ে এই পেশায় এসেছিলেন পূজা। নিজের মতো করেই একটা লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। ভালো কাজের সঙ্গে থাকার জন্য অনেক কাজ ছাড়তে হয়েছে।

পূজা সেনগুপ্ত
ছবি: প্রথম আলো

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পূজা বলছিলেন, ‘যখন আমরা নিজেদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাই, তখন মনে হয় প্রত্যাশা অনেক ছোট ছিল; আমরা আরও বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করি। আলাদা ডিজাইন করে কাজ করছি। আমাদের স্টুডিও রয়েছে। এই চলার পথে সব সময় মনে হয়েছে, নিবেদন আর সততা থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। এটাই আমাদের পথ চলতে সহায়তা করেছে। আর যখনই আমরা লক্ষ্যে পৌঁছেছি তখনই মনে হয়েছে, আমাদের পথটা ছোট ছিল। আবার নতুন নাচ নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছি।’

বাধা পেরিয়ে
জার্মানিতে পড়তে যাওয়ার সুযোগ ছিল পূজার, কিন্তু যাননি। নাচ নিয়ে চর্চা করেন এবং একটা সময় ভারতে যান শিখতে। ফিরে এসে শুরুতে নাচ নিয়ে থাকার জন্য অনেক কথাই শুনতে হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, ‘নাচ করে কী হবে।’ কারণ, তখন নাচ যে পেশা হতে পারে, সেটাই অনেকে জানতেন না। পূজা বলেন, ‘ভারত থেকে ফিরে এসে তুরঙ্গমী প্রতিষ্ঠা করি। শুরু থেকেই আমরা চেয়েছি পেশাগতভাবে নতুনত্ব আনতে। কিন্তু প্রথাবিরোধী কাজ করাটা কঠিন। তবু কিছু মানুষ আমাদের প্রশংসা করেছেন। পাশে থেকেছেন। শুরুতে এটা আমাদের কাছে স্বীকৃতি মনে হয়েছে। দেশের প্রচলিত ধারা মেনে কাজ করিনি। এটা ছিল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। কম কাজ করেছি, কিন্তু ভালো করেছি। নতুন করে নাচের জন্য সিচুয়েশনাল মিউজিক তৈরি করেছি। নাচের মাধ্যমে আমরা গল্প করছি। এটা আমাদের নাচের শৈল্পিক দিককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে আজ আমাদের আন্তর্জাতিক দর্শক তৈরি হয়েছে। এখন বিদেশি আয়োজকদের কাছে নতুন করে আমাদের পরিচয় দিতে হয় না।’

লক্ষ্য আরও বড়
নাচ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ থেকে তেমন পদচারণ ছিল না বলে জানালেন পূজা। কথায় কথায় ভাগাভাগি করে নিলেন ২০১৪ সালের একটি ঘটনাও। তিনি বললেন, ‘ব্যাংককে একটি নাচের উৎসবে অংশ নিতে যাই। তখন দেখি, সবাই আমাদের ধরে নিয়েছেন, আমরা ভারতীয়। কারণ, আমরা যেভাবে নেচেছি, যে শাড়ি পরেছি, সেগুলো একদমই ভারতীয়দের মতোই। সেদিন মনে হলো, আমাদের নাচে নিজস্বতা ফুটিয়ে তুলতে হবে। যেটা আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি, জাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। কেউ যেন দেখলেই বুঝতে পারে, আমরা বাংলাদেশের। সেই জায়গায় আমরা আলাদা হতে পেরেছি। আমরা নিজেদের আলাদা ব্র্যান্ডিং করতে সমর্থ হয়েছি।’ ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে এই নৃত্যশিল্পী জানান, ভবিষ্যতে তাঁরা নৃত্যশিল্পীদের চাকরি দিতে চান। সেই পথেই হাঁটছেন। এ ছাড়া রেপার্টরি হিসেবে তাঁদের নিজস্ব মিলনায়তন দরকার। সেটা নিয়েও কাজ করবেন।