থিয়েটারে হাতেখড়ি, ওটিটিতে পরিচিতি
‘ভাত ছাড়া আমার হয় না, তাই দিনে তিন বেলাতেই ভাত খাই,’ হেসে বলছিলেন রওনক রিপন। নিকেতনের ৩ নম্বর রোডের এক রেস্তোরাঁয় রিপনের দেখা মেলে। সকালের নাশতায় ভর্তা-ভাত খাচ্ছিলেন তিনি। মুখভর্তি ভাত, তাই হাতের ইশারায় বসতে বললেন। খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বের হতে হতে হেসে বললেন, ‘যত কিছুই হোক, ভাত না হলে চলে না, ভাই।’ হোটেল থেকে বের হয়ে চললাম ১ নম্বর রোডের একটি স্টুডিওতে। সেখানে শুরু হয় আড্ডা।
ধীরে ধীরে রওনক রিপন যেন নিজের জীবন–বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন। কথার টানে ফিরলেন নব্বইয়ের দশকে। জানালেন, অভিনেতা বা পরিচালক হওয়ার কথা কোনো দিনই তাঁর মাথায় আসেনি। এ পথই তাঁকে পথ চিনিয়েছে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে, যদিও তাঁর পৈতৃক ভিটা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। পারিবারিক নাম রিপন চন্দ্র সরকার। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বন্ধু আবদুল কাদিরের মাধ্যমে তিনি প্রথম যোগ দেন নারায়ণগঞ্জের শিশুসংগঠন ক্রান্তি খেলাঘর আসরে। সেখানেই শুরু হয় তাঁর মঞ্চনাটক, পথনাটক আর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া।
ক্রান্তি খেলাঘর আসরে টানা দুই বছর মঞ্চে ছিলেন রওনক রিপন। তবে এইচএসসি পরীক্ষার সময় পড়াশোনায় মন দিতে গিয়ে থিয়েটারের বাইরে থাকতে হলো তাঁকে। সারা দিন পড়াশোনা, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা—এভাবেই চলছিল সময়। একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা বসেছিল নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আড্ডার ফাঁকেই রিপন গলা ছেড়ে গান ধরলেন। সেদিন সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই বন্ধু সানি ও বিপ্লব, যাঁরা ঐকিক থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গান শেষ হতে না হতেই তাঁরা বলে ওঠেন, ‘তুমি তো দারুণ গান করো! চাইলে আমাদের সঙ্গে থিয়েটার করতে পারো।’ রিপনের মন যেন সেই কথার অপেক্ষায়ই ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই বলে ফেললেন, ‘তোমরা তো থিয়েটার করো, আমারও খুব ইচ্ছা। খেলাঘরে করতাম, এবার যদি মূল দলে কাজ করার সুযোগ পেতাম!’ বন্ধুরা জানালেন, ‘আজই সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের ফ্লোরে কল আছে, চাইলে চলে এসো।’
রিপনের কাছে এটা যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। সন্ধ্যায় ফ্লোরে গিয়ে দেখলেন, থিয়েটারের গুরু অসিত কুমার, যিনি রিপনের কলেজেরও শিক্ষক ছিলেন। তবে রিপনকে চিনতেন না তিনি। বন্ধু সানি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাদা, ও আমাদের সঙ্গে থিয়েটার করতে চায়।’ এ কথা শুনে অসিত কুমার রিপনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী পারো তুমি?’ রিপন উত্তর দেওয়ার আগে সানি যোগ করেন, ‘দাদা, ও খুব ভালো গান পারে।’ তখন অসিত কুমার রিপনকে একটি গান গাইতে বলেন। রিপন গাইতে শুরু করতেই অসিত কুমার নিজে ঢোল নিয়ে সংগত দিলেন। রিপন স্মৃতির রোমন্থন করে বলেন, ‘দাদা এত ভালো মিউজিশিয়ান ছিলেন! তাঁর হাত দিয়েই আমার থিয়েটারের হাতেখড়ি। তিনি আর নেই, কিন্তু সেই মুহূর্ত আজও আমার কাছে অমূল্য।’
পর্দায় অভিনয়
রিপন প্রথম টেলিভিশন নাটকের প্রস্তাব পান ২০০৭ সালে। মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে কাজের প্রস্তাব দেন নাট্যকার ও নির্দেশক কাজী শাহিদুল ইসলাম। ২০০৭ সালে তাঁর নির্দেশিত ১৩ পর্বের ‘ঘূর্ণিবাতাস’ ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব ‘আওলাদ উপাখ্যান’–এর প্রধান চরিত্র আওলাদ হিসেবে চূড়ান্ত করেন তাঁকে। নাটকটির যখন সম্পাদনা চলছিল, তখন কয়েকটি দৃশ্য দেখে রিপনের অভিনয় পছন্দ করেন আরেক নির্মাতা আশরাফুল আলম। তিনি ধারাবাহিক নাটক ‘পোস্টারের’ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে রিপনকে প্রস্তাব দেন। নাটকে রিপনের চরিত্রটি দর্শকেরা পছন্দ করেন। এরপর বিভিন্ন চরিত্রে প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি।
টেলিভিশনে শুরুর দিনগুলো নিয়ে রিপন বলেন, ‘জলে ভাসা পদ্মের মতো তখন ভাসছিলাম। অভিনয় করছি, আবার সহকারী পরিচালক হিসেবেও আছি।’ একসময় একের পর এক কাজ আসতে থাকে। উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘অতঃপর অরিন্দম কহিলো’, ‘নরসুন্দরী’, ‘সঙগ্রাম’, ‘অভিমান’, ‘লোটাকম্বল’ ও ‘উৎসব’। তবে দর্শকের কাছে রিপনের পরিচিতি বাড়ে ওটিটি কনটেন্টে। তাঁর অভিনীত ‘মহানগর ২’, ‘কারাগার ১’, ‘কারাগার ২’, ‘টেক্কা’, ‘মিশন হান্টডাউনে’ তাঁর অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে। চলতি বছর মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’।
নির্দেশনা
অভিনয়ের পাশাপাশি কাজী শহিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করছিলেন রিপন। টানা ২০১২ সাল পর্যন্ত পারভেজ আমিন, রিপন নবীসহ আরও কয়েকজন নির্মাতার সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। সে বছরই নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম নাটক ‘রোদের অর্কেস্ট্রা’। নাটকের চিত্রনাট্য লেখেন শিবু কুমার শীল। বাবার থেকে টাকা নিয়ে নাটকটি নির্মাণ করেন রিপন। এটি চাড়ুনীড়ম কাহিনিচিত্র উৎসবে তরুণ নির্মাতা হিসেবে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা এনে দেয়। তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আরও রয়েছে ‘আমি অভিনেতা’, ‘কবিতার কর্মশালা’, ‘রঙের অনেক রঙ’। মুক্তির অপেক্ষায় আছে তাঁর নির্দেশিত নাটক ‘জ্বীনের বাদশাহ’, ‘তুসি আর সমানে সমান’। আগামী নভেম্বর মাসে রওনক রিপন নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘দেউড়ি’। যেখানে উঠে আসবে একটি কুমারপাড়ার গল্প। অভিনয় আর নির্দেশনা—দুটোই সমানতালে এগিয়ে নিতে চান রিপন।