‘লেগাদ লেগাদ মেনাবোনা, জোয়ান কো জোয়ান কো/ লেগাদ লেগাদ বাহাকো লেকাজে, ধরতি মা বাগান তালারে’—শুনলেই মনে হবে, কোনো এক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কথা, আসলেই তা–ই। এটি একটি সাঁওতালি গান। আর সাঁওতালদের জীবনাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের নানা দ্বান্দ্বিক বিষয়ের নাটক ‘রাঢ়াঙ’।
২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম মঞ্চে আসে ‘রাঢ়াঙ’। ১৮ বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে আরও ২৪টি প্রযোজনা মঞ্চে এনেছে আরণ্যক। তারই ফাঁকে ফাঁকে ৫০, ১০০, ১৫০ মঞ্চায়নের ধাপ ছাড়িয়ে ২০০তম প্রদর্শনীর দিকে এগিয়ে চলেছে ‘রাঢ়াঙ’। সাঁওতালদের জীবনাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার ও সংগ্রামী ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাধর্মী নাটকটি লিখেছেন মামুনুর রশীদ, নির্দেশনাও তাঁরই।
আজ বৃহস্পতিবার ‘রাঢ়াঙ’-এর ১৯৯ ও আগামীকাল শুক্রবার ২০০তম প্রদর্শনী হবে। ২০০তম মঞ্চায়নের মাইলফলক স্পর্শ করা উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে দুই দিনের এক উৎসবের আয়োজন করেছে আরণ্যক। কাল সকাল ১০টায় জাতীয় নাট্যশালার সেমিনারকক্ষে আছে সেমিনার। মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন মেসবাহ কামাল। বিকেল চারটায় পরীক্ষণ থিয়েটার লবিতে আরণ্যকের সাবেক সদস্যদের সম্মিলনী। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশেই উদ্যাপিত হবে ‘রাঢ়াঙ’-এর ২০০তম মঞ্চায়ন।
‘রাঢ়াঙ’ আরণ্যকের ৪০তম প্রযোজনা। ‘রাঢ়াঙ’ সাঁওতালি শব্দ; এর অর্থ দূরাগত মাদলের ধ্বনিতে জেগে ওঠার আহ্বান। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারা প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাদের মধ্যে সাঁওতাল অন্যতম। ১৯৪৯ সালে নাচোলের বিদ্রোহে পরাস্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের ওপর সংঘটিত অনাচার-অত্যাচার ও অভিবাসনের কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটক ‘রাঢ়াঙ’।
আন্দোলন ব্যর্থ হলে সাঁওতালদের জীবনে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। কেউ কেউ জেলবন্দী হয়, কেউ কেউ হয় ফেরারি। একটা সময় বিশ্বম্ভরের সহযোগিতায় নাচোল থেকে নওগাঁর ভীমপুরে চলে আসে তারা। ঘর হবে, নিজস্ব জমি হবে—এ-ই বলে তাদের স্বপ্ন দেখায় বিশ্বম্ভর। কিন্তু তা আর হয় না। বিশ্বম্ভর মারা যায়। সাঁওতালদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘকাল কেটে যায়। ২০০০ সালে এসে আলফ্রেড সরেনের নেতৃত্বে ভূমির অধিকার নিয়ে আবারও জেগে ওঠে সাঁওতালরা। কিন্তু সরেনকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এসব বিষয় উঠে এসেছে নাটকে।
পশ্চিমবাংলার নাট্যগবেষক ও সমালোচক অংশুমান ভৌমিক ঢাকা ও কলকাতায় তিনবার নাটকটি দেখেছেন। কালি ও কলম পত্রিকায় ‘তাহাদের’ উৎকণ্ঠার কথা, উৎখাতের কাহিনি—শিরোনামে প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, তত ধার বাড়ছে ‘রাঢ়াঙ’-এর, ভারেও কাটছে।...‘রাঢ়াঙ’-এর গতি পাহাড়ি ঝোরার মতো। চেনা ছকে বাঁধা নয়। এঁকেবেঁকে পথ কেটে চলেছে। দৃশ্য ও সংলাপ রচনার যে পশ্চিমি ছাঁদ মামুনুর রশীদের আর পাঁচটা নাটকে থাকে, ‘রাঢ়াঙ’ তার থেকেও আলাদা। সত্যি বলতে কি, কথা নয়, আজকালকার কেতায় যাকে সিনোগ্রাফি বলি, সেটাই এ নাটেকর তুরুপের তাস।’
টেলিভিশন, চলচ্চিত্র আর ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের ব্যস্ততায় ইচ্ছা থাকলেও এখন মঞ্চে আর নিয়মিত কাজ করতে পারেন না চঞ্চল চৌধুরী। তবে পুরোনো নাটক হলে এবং সময়-সুযোগ মিললে মঞ্চে ঠিকই ফেরেন। যেমন আজ ও আগামীকালের ‘রাঢ়াঙ’-এর প্রদর্শনী দুটিতে থাকবেন চঞ্চল।
তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা তো সব সময় থাকে। সময় ও ব্যস্ততার কারণে হয় না। এখন তো নতুন অনেক প্রযোজনা আসছে, আর পুরোনো নাটকের মঞ্চায়নও সেভাবে হয় না। যত দিন নিয়মিত হতো, শুটিং থেকে গিয়েও মঞ্চে কাজ করেছি। অভিনয় তো এখন পেশা হয়ে গেছে, তাই মঞ্চে সব সময় কাজ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা থাকেই—আবার কাজ করব, আবার মঞ্চে দাঁড়াব। এটা নিশ্চয় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘আরণ্যক থেকে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেছি এবং যেখানে এসে পৌঁছেছি, সেটাও আরণ্যকের কারণেই। আরণ্যকের পাদপ্রদীপে আমার ঠাঁই হয়েছিল বলেই আজ এত মানুষের ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়েছি।’
আজ ও আগামীকালের বিশেষ প্রদর্শনীতে আরও দেখা যাবে শামীম জামান, আ খ ম হাসানসহ পর্দার অনেক জনপ্রিয় মুখ, শুরুর দিকে যাঁরা এ নাটকে অভিনয় করতেন। ‘রাঢ়াঙ’-এ আরও অভিনয় করেছেন সুজাত শিমুল, অপু মেহেদী, নিকিতা নন্দিনী, শামীমা শওকত, রুবলী চৌধুরী, সাজ্জাদ সাজু, ঊর্মি হোসেন, কামরুল হাসান, বাপ্পাদিত্য চৌধুরী, দিলু মজুমদার, সাঈদ সুমন, পার্থ চ্যাটার্জি প্রমুখ।
দলপ্রধান, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘২০০তম প্রদর্শনীর পর আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় আরণ্যকের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে ২০১তম প্রদর্শনী করে আমরা এবারের মতো ‘রাঢ়াঙ’-এর ইতি টানব।’