দেড় শ বছরের স্মৃতি নিয়ে ফিরছে ‘নীলদর্পণ’

১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দিন। এক নতুন যুগের সূচনা হলো সেদিন। বাঙালি টিকিট কেটে বাংলা নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

৭ ডিসেম্বর কলকাতার তপন মঞ্চে বাঙলা থিয়েটার পরিবেশন করবে ‘নীলদর্পণ’। এর আগে জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে চলছে চূড়ান্ত মহড়া। ছবি: তানভীর আহম্মেদ

মঞ্চের এক পাশে আলো এসে পড়েছে। ঠিক সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রম্পটার, মামুনুর রশীদ। শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করলেন, ‘অদ্য রজনী ইংরেজি ১৮৭২ সাল, ৭ ডিসেম্বর...মোকাম কলকাতায় এ নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে। উদ্যোক্তা ন্যাশনাল থিয়েটার।’ তাঁর কথা শেষ হতেই দর্শক সারিতে শোরগোল। চাবুক পেটাতে পেটাতে চাষিদের নিয়ে আসে ইংরেজ নীলকরেরা। শোনা যায়, নারী-পুরুষের আর্তনাদ। শুরু হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’।
আমরা তখন জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে, ‘নীলদর্পণ’-এর কারিগরি প্রদর্শনীতে। দর্শকের প্রবেশাধিকার নেই। নাটকের নির্দেশক মামুনুর রশীদের অনুমতি নিয়ে বসে গেলাম দর্শকশূন্য মিলনায়তনের এক পাশে। বাংলাদেশের প্রথম রেপার্টরি গ্রুপ বাঙলা থিয়েটারের প্রযোজনা এই নীল দর্পণ।
পুরোনো এই নাটক নতুন করে মঞ্চে আনার কারণ আছে। ঠিক দেড় শ বছর আগে ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্যোগে কলকাতায় মঞ্চস্থ হয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের কালজয়ী এই নাটক। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর, শনিবার। সেদিনই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চস্থ হয় নাটক। শুরু হয় মৌলিক বাংলা নাটকের পেশাদার অভিনয়ের যাত্রা। এর আগে মঞ্চনাটক হতো ইংরেজ সাহেব, জমিদারদের আঙিনায়, পূজামণ্ডপে। কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার ঘেরাটোপ থেকে নাটককে মুক্ত করে ৭ ডিসেম্বর সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসে।

আজ মঙ্গলবার ৬ ডিসেম্বর হবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। আজ গিরিশ ঘোষের বাড়ির সামনে থেকে শোভাযাত্রাও করা হবে। এরপর এক বছর ধরে চলবে এই উদ্‌যাপন। বছরব্যাপী এই অনুষ্ঠানে প্রতি মাসের একটি শনিবার করে ১৩টি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। হবে নাটকপাঠ। বাংলা রঙ্গালয়ের একাল–সেকাল নিয়ে হবে সেমিনার, আলোচনা সভা। আজ  থেকে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর।
মামুনুর রশীদ নতুন করে নির্মাণ করেছেন ‘নীলদর্পণ’

সেই দিনটিকে স্মরণ করে, দর্শনীর বিনিময়ে সাধারণ মানুষের সামনে নাটক মঞ্চায়নের দেড় শ বছর উপলক্ষে বছরব্যাপী নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছে কলকাতার বঙ্গ নাট্য সংহতি। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের নাট্যজন মামুনুর রশীদ নতুন করে নির্মাণ করেছেন ‘নীলদর্পণ’। এ নাটক দিয়েই শুরু হবে বঙ্গ নাট্য সংহতির বছরব্যাপী উৎসব।

দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কাহিনিসূত্র বাস্তব ঘটনাকেন্দ্রিক। এ নাটকের ঘটনা, বিষয়, ছাপা, প্রকাশনা, প্রথম মঞ্চায়ন—সবই বাংলাদেশে। ঢাকায় থাকাকালীন দীনবন্ধু মিত্র এটি লেখেন।

গত রোববার গ্রিন রুমে মেকআপ নিচ্ছিলেন মামুনুর রশীদ। অন্যদের মেকআপ, কস্টিউমসহ অভিনয়ের নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে জানালেন ঢাকার বিভিন্ন দলের নানা প্রজন্মের শিল্পীরা কাজ করছেন এই নাটকে। বেশ কিছুদিন ধরে মহড়া দিয়েছেন তাঁরা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তাঁদের ২৫ সদস্যের দল কলকাতায় পৌঁছেছে। ৭ ডিসেম্বর কালীঘাটের তপন মঞ্চে পরিবেশন করা হবে এই নাটক, সেদিনই এ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী। দেশে ফিরে ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে হবে প্রদর্শনী।

নাটকে অভিনয় করেছেন ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, সুবচন নাট্য সংসদ, দেশ নাটক, নাট্যকেন্দ্র, বাতিঘর, প্রাচ্যনাট, মেঘদূতসহ ঢাকার বিভিন্ন দলের সদস্যরা।

নাটকে অভিনয় করেছেন মামুনুর রশীদ, ফয়েজ জহির, শুভাশিস ভৌমিক, আহাম্মেদ গিয়াস, শামীমা শওকত লাভলী, শাহনাজ খুশি, সুষমা সরকার, লায়লা বিলকিস ছবি, সঙ্গীতা চৌধুরী, হাশিম মাসুদ, সাঈদ সুমন, খালিদ হাসান রুমি, সুজাত শিমুল, রিয়া চৌধুরী, তাসমী চৌধুরী, শাহরান, তাজউদ্দীন তাজু, রুহুল আমিন ও উচ্ছ্বাস ঘোষ।

নাট্য-গবেষক অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী জানালেন, প্রথম মঞ্চায়নের জন্য মাসিক ৪০ টাকা ভাড়ায় কলকাতার চিৎপুরে মধুসূদন সান্ন্যালের বাড়ির বাইরের উঠানটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। প্রথম প্রদর্শনীতে টিকিটের দাম রাখা হয়েছিল প্রথম শ্রেণি এক টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি আট আনা। প্রথম রজনীতে মোট ২০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। একাই চারটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। আরও অভিনয় করেছিলেন মতিলাল সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অবিনাশচন্দ্র কর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু ও মহেন্দ্রলাল বসু। নারী চরিত্রে পুরুষেরাই অভিনয় করেছিলেন।

জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে চলছে চূড়ান্ত মহড়া। ছবি: তানভীর আহম্মেদ
নানা পর্যায় অতিক্রম করে একদিন ন্যাশনাল থিয়েটারের নাট্যযাত্রা থেমে গেছে কিন্তু বন্ধ হয়নি বাঙালির নবনাট্যযাত্রা। ভিন্ন নামে, ভিন্ন স্থানে বাঙালির নাট্যচর্চা ন্যাশনাল থিয়েটার প্রবর্তিত পথরেখা ধরে চলতে চলতে আজকের এই জায়গায় এসেছে।’
নাট্য-গবেষক অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী

সুলভ সমাচার পত্রিকায় নীল দর্পণ নাটকের প্রশংসা করে লেখা হয়, ‘এখন নাট্যশালায় মাছের তেলে মাছ ভাজা হবে। টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার চলবে। ধনীদের তোষামোদ করে নয়।’ ১২ ডিসেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকা লেখে, ‘শুনেছি এই ন্যাশনাল থিয়েটার কোনো বড় মানুষের বিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত হয়নি। এ কথা সামান্য নয়।’

পরে ২১ ডিসেম্বর নাটকের দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। যেখানে নারী দর্শকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বহু দর্শক টিকিট না পেয়ে ফিরে যান। টিকিট বিক্রি করে ৪৫০ টাকা আয় হয়। সেদিন দর্শকসারিতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘নানা পর্যায় অতিক্রম করে একদিন ন্যাশনাল থিয়েটারের নাট্যযাত্রা থেমে গেছে কিন্তু বন্ধ হয়নি বাঙালির নবনাট্যযাত্রা। ভিন্ন নামে, ভিন্ন স্থানে বাঙালির নাট্যচর্চা ন্যাশনাল থিয়েটার প্রবর্তিত পথরেখা ধরে চলতে চলতে আজকের এই জায়গায় এসেছে।’

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তাঁদের ২৫ সদস্যের দল কলকাতায় পৌঁছেছে

বাঙালি কৃষক ও তুলনামূলক অভিজাত শ্রেণির ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনিই এ নাটকের মূল উপজীব্য। কীভাবে কৃষক গোলক বসুর পরিবার নীলকর অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেল, সাধুচরণের মেয়ে ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হলো তার এক মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটক। বলে নেওয়া ভালো, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কাহিনিসূত্র বাস্তব ঘটনাকেন্দ্রিক। এ নাটকের ঘটনা, বিষয়, লেখা, ছাপা, প্রকাশনা, প্রথম মঞ্চায়ন—সবই বাংলাদেশে। ঢাকায় থাকাকালীন দীনবন্ধু মিত্র এটি লেখেন। এটি ১৮৬০ সালে ঢাকার প্রথম ছাপাখানা ‌‌বাংলা প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

আলোক পরিকল্পনা করেছেন ঠাণ্ডু রায়হান, মঞ্চ পরিকল্পনা করেছে ফয়েজ জহির, সংগীত পরিকল্পনা করেছেন পরিমল মজুমদার, মঞ্চ ব্যবস্থাপক সুজাত শিমুল, সহকারী নির্দেশক শামীমা শওকত লাভলী এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছেন সামিউন জাহান দোলা।
বাঙালি কৃষক ও তুলনামূলক অভিজাত শ্রেণির ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনিই এ নাটকের মূল উপজীব্য

নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর দিনটি আমাদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এই দিনের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা গ্রুপ থিয়েটার চর্চা করে যাচ্ছি। বাংলার পেশাদার থিয়েটার গড়ার ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছিল এ নাটক। বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম দিনের সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনের উদ্বোধনী নাটকে থাকছে সেই ‘নীলদর্পণ’, যা আমি করছি। এটি আমাদের দেশের জন্য গর্বেরও।’ তিনি জানান, ভবিষ্যতে প্রযোজনাটি নিয়মিত করার ইচ্ছা আছে।