নবাবের দরবারে কপিলা...

যাত্রাপালা ‘নবাবের দরবারে কপিলা’র দৃশ্যপ্রথম আলো

কপিলা। মানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র সেই কপিলা। যিনি কুবের মাঝির সঙ্গে পালিয়ে ময়না দ্বীপে গিয়েছিলেন। সমাজে তিনি কুলটা। সেই কপিলাকে এই যাত্রাপালার অনিবার্যও একটি চরিত্র হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। কপিলা ময়না দ্বীপ থেকে কোনো নবাবের দেশে ব্যবসায়ী হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে এই নারীর পণ্য নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়। ষড়যন্ত্র শুরু হয় নবাবের বিরুদ্ধেও। এই প্রেক্ষাপটে রচিত যাত্রাপালা ‘নবাবের দরবারে কপিলা’।

নাটোরের চলন নাটুয়া প্রযোজিত পালাটি গত সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাতে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পরীগাছা গ্রামের বৈশাখী মেলায় মঞ্চস্থ হয়েছে। পালাটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ফারুক হোসেন। যাঁরা সেদিনের পালাটি দেখেননি, তাঁদের জন্য রইল বর্ণনা। আমরা যা দেখেছি, তা–ই বলছি।
পালার শুরুতে নেপথ্যে কথকের গলা শোনা যায়—‘আপনাদের জানা, সংক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি কেবল। মানিক বাবুর “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসের কপিলা কুবের মাঝির শ্যালিকা। আপনারা জানেন, কুবের মাঝির একদিকে পঙ্গু স্ত্রী আর অন্যদিকে শ্যালিকা। এ দুয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় কুবের-কপিলাদের প্রেমের মানসিকতা। অথবা কপিলা-কুবের যাতে মিলিত হয়, তার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়ার সূক্ষ্ম কারিগর হোসেন মিয়ার কূটকৌশল কিংবা নিয়তি বলতে পারেন, সবই নির্ধারিত, কপিলাকে নিয়ে কুবেরের পালানো ভিন্ন পথ খোলা ছিল না। দর্শকশ্রোতা, হোসেন মিয়ার নতুন রাজ্য ময়না দ্বীপের কথা নিশ্চয় মনে আছে, নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে সে দেশে। কথা শেষ হতেই মঞ্চে আসেন কপিলা ও কুবের।

দর্শকের ভিড়
প্রথম আলো

কুবেরের হাতে নৌকার বইঠা। কপিলা নিবেদন করে, আমারে নিবা মাঝি? বলেই রহস্যময় হাসি হাসে।
-রহস্য করবি না কপিলা।
কপিলা হাসি থামিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়, দুঃখী ভাব দেখায়। কুবের আকুতিভরা কণ্ঠে বলে, যাবি, যাবি কপিলা? কপিলা সম্মতি জানায়।
বুকে বল পাইলাম বলে কপিলাকে নিয়ে প্রস্থান করে কুবের। এবার কথক উঠে আসে মঞ্চে।... কী এক অনিবার্য আকর্ষণের কারণে কপিলার ইচ্ছায় কুবেরের সঙ্গে অথবা কুবেরই প্রলোভন দেখিয়ে কপিলাকে নিয়ে অজ্ঞাত আশার নতুন আলো জ্বালিয়ে পালিয়েছিল নতুন এক দ্বীপে। কথক দর্শককে সম্বোধন করে বলেন, বড়ই দুঃখের কথা, কপিলার কপালে সুখ সইল না। সেখান থেকে পালাতে হলো তাকে। কারণটা খোলাসা করেই বলি, কুবের মাঝি অন্য এক নারীর প্রতি আসক্ত হয়েছিল। কপিলা সেখানে কুবের মাঝির কাছ থেকে যোগ্য সম্মান পায়নি। সে অপমান সইতে না পেরে কোনো এক নবাবের দেশে আশ্রয় নেয় কপিলা।
এবার কথা দর্শকদের উদ্দেশে কতগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘আপনারা এই অর্বাচীন বর্ণনাকারীকে প্রশ্ন করতেই পারেন, কোন সে নবাবের দেশ? আরও প্রশ্ন করতে পারেন, কপিলা যদি পালিয়েই এল বা গেল, স্বামীর বাড়ি কিংবা বোনের বাড়ি কেন গেল না? পরের প্রশ্নের উত্তর আগে দিই। কপিলা, হ্যাঁ কপিলার কথা বলছি, লজ্জায় যেতে পারেনি স্বামীর ঘরে। এক দর্শককে উদ্দেশ্য করে কথক বলে, এমন নাফরমানি কাজ করা আপনার স্ত্রী ফিরে এলে কি ঘরে ফিরিয়ে নিতেন?

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পরীগাছা গ্রামের বৈশাখী মেলায় মঞ্চস্থ হয়েছে
প্রথম আলো

একজন নারীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘এই যে আপা আপনি, আপনি আপনার বোন আপনারই স্বামীকে নিয়ে পালিয়ে গেলে তাকে কি সাদর সম্ভাষণ জানাতেন? না। আপনারা হুদাই আপসোস করতেছেন। যা–ই হোক, ঘটনার ডালপালা বাড়ায়া আপনাদের যাতনা দিবার কোনো ইচ্ছা নাই। কোন নবাবের দেশ বেছে নিয়েছে, তার উত্তর আপনারাই খুঁজে বের করবেন। এটা না করতে পারলে বসে বসে কি আঙুল চুষবেন? মাফ করবেন আমাকে, আজকের পালায় বেফাঁস কথাবার্তা চলবে। থুক্কু, কি আবোলতাবোল বলছি। আসল কথায় আসি। বলছিলাম বিশিষ্ট নারী ব্যবসায়ী কপিলার কথা। ময়না দ্বীপ থেকে ফেরার পরে কপিলার একলা চলার কথা, কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। চাইলেই তো আর একলা নারী হয়ে একলা চলতে পারে না! সমাজ বলে একটা কথা আছে না! দর্শকেরা, কী ঘটে কপিলার জীবনে, বলতে পারেন মূল ঘটনা শুরু এখান থেকেই।
পণ্য বিক্রির বিনিময়ে সিপাহশালার কপিলার কাছে ঘুষ চান। মন্ত্রী বলেন, ‘এ রাজ্যে ব্যবসা করতে হলে আমাদের কিছু না কিছু দিতেই হবে। এক শ বার দিতে হবে, হাজারবার দিতে হবে। কপিলা রাজি না হলে নবাবের দরবারে তার নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়। সিপাহশালার দরবারে গিয়ে বলে, এই রমণীর নাম কপিলা। খুবই ডেঞ্জারাস ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে, যা দেশের জন্য চরম বিপজ্জনক। তিনি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী কপিলাকে ভন্ড, মিথ্যুক, অসভ্য নারী বলে অপবাদ দেয়। কপিলা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করে। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে সে মানহানির মামলা করার হুমকি দেয়। সব শুনে অভিযোগের প্রমাণ না পেয়ে নবাব কপিলাকে রাজ্যে ব্যবসায়ের অনুমতি দেন।
এবার মন্ত্রী ও সিপাহশালার মিলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামে। সিপাহশালার নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র চ্যালেঞ্জ করে।

এতে সিপাহশালার পরাজিত হয়। ক্ষমা চায়। নবাব ক্ষমা করে দিয়ে নতুন করে দেশ গড়ার আহ্বান জানান। তারা এবার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে।
মঞ্চে আসে বিবেক... ভোলামন, ঘোড়ার পিঠে হাতির আসন, আজগুবি এক বচন, পোশাক পরলেই হয় না যোগ্য রাজন...।

পালাটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ফারুক হোসেন
প্রথম আলো

এবার নবাবের বিরুদ্ধে সিপাহশালার গং নতুন ষড়যন্ত্র করে। তারা গণশুনানিতে নবাবকে প্রজাদের মুখোমুখি করে। প্রজারা একে একে আট আনার রুটি এক টাকা হয়েছে, এক টাকার পণ্য দুই টাকা হয়েছে—এ রকম নানা অভিযোগ করেন।
নবাব কপিলাকে তলব করেন। কপিলা বহির্বিশ্বে কোন জিনিসের কত দাম বেড়েছে, তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন। সেই তুলনায় দেশীয় পণ্যের দাম কমই আছে।
এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে নবাব অর্থমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে তার গলার উত্তরীয় কপিলার গলায় পরিয়ে দিয়ে তাকেই অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন। কপিলা দেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নবাবকে বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন—ধনী–গরিব সবাইকে উৎপাদনের অংশ নিতে হবে, কৃষি খাতে নামমাত্র সুদের ঋণ দিতে হবে, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কারখানা নির্মাণে বিশেষ ঋণ সুবিধা দিতে হবে।
এরপর নবাবের বেগম ঘোষণা করেন, এবার আমরা সুন্দর একটা পাত্র দেখে কপিলার বিয়ে দেব।