ভারতে যাওয়ার আগে ঢাকায় ‘খনা’, ফিরলেন নিত্রা
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশ’ অথবা ‘যদি থাকে বন্ধুরে মন, গাঙ সাঁতরাইতে কতক্ষণ’, এসব কথা আগে শোনা যেত দাদি-নানির কাছে। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে লোকমুখেই বেশি, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মুখে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের বহু আগের কথা; কবে রোদ হবে, কবে বৃষ্টি হবে, কখন ফসল বুনলে গোলা ভরবে বা কখন অনাহারে কাটবে দিন, তা গ্রামে প্রৌঢ় মানুষজন বলে দিতেন। কারণ, তাঁরা জানতেন খনার বচন।
সিংহলের রাজকন্যা খনা, যাঁর আরেক নাম লীলাবতী। তিনি জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী। খনার সেই উপকথাকে নাট্যরূপ দিয়ে নাট্যদল বটতলা প্রথম মঞ্চে আনে ২০১০ সালের ৯ মার্চ। বহুদিন ধরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে এ নাট্যদল মঞ্চস্থ করে আসছে নাটক ‘খনা’। ইতিমধ্যে কাহিনি ও নাট্য আঙ্গিকের জন্য বেশ দর্শকপ্রিয়তাও অর্জন করেছে নাটকটি। শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটারে নাটকটির ৮১তম প্রদর্শনী হয়। নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা। নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। বটতলার তৃতীয় প্রযোজনা এটি।
ভারতের রাষ্ট্রীয় নাট্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা আয়োজিত ভারত রঙ্গ মহোৎসবের ২৩তম আসরে ‘বটতলা’ আমন্ত্রিত হয়েছে ‘খনা’র মঞ্চায়নের জন্য। ফেব্রুয়ারি ’২৪–এ আয়োজিতব্য এশিয়ার বৃহত্তম এ উৎসবে বটতলা ‘খনা’ নাটকটির দুটি মঞ্চায়ন করবে।
দলের পরিচালক যোগাযোগ হুমায়ূন আজম রেওয়াজের ভাষ্য, এই উৎসবের প্রস্তুতি এবং নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দলের সদস্যরা দারুণ উজ্জীবিত এখন। এই প্রযোজনাটি বিশেষ হয়ে উঠছে আরও একটি কারণে। দুরারোগ্য জিবিএস এ আক্রান্ত হয়ে মঞ্চ থেকে দীর্ঘ বিরতির পর আবার মঞ্চে নাটকের নামভূমিকায় হাজির হচ্ছে খনার নাট্যকার, শিক্ষক এবং নন্দিত অভিনয়শিল্পী সামিনা লুৎফা নিত্রা। এই সুনন্দ প্রত্যাবর্তন বটতলা তথা নাট্যাঙ্গনের সুহৃদদের জন্য আনন্দ সংবাদ বিশেষ।
নিত্রাকে নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় সফলভাবে ‘খনা’র মঞ্চায়ন করেছে বটতলা। নাটকে আরও আছেন ইমরান খান, ইভান রিয়াজ, তৌফিক হাসান, শারমিন রহমান, শেউতি শাহগুফতা, পঙ্কজ মজুমদার, কামারুজ্জামান সাঈদ, হুমায়ূন আজম রেওয়াজ, রানা তিওয়ারি, হাফিজা আক্তার, আবদুল কাদের, মিজানুর রহমান, শাহনেওয়াজ ইফতি, রিশাদুর রহমান, লায়েকা বশীর, পলাশ নাথ, সানজিদা ইয়াসমীন, আশরাফুল অশ্রু, সানজানা ফারাহ প্রমুখ।
‘খনা’ নাটকটি বিদুষী ‘খনা’, যার অন্য নাম লীলাবতী, তাঁকে কেন্দ্র করে। তাঁর গল্পটা অনেক পুরোনো, কিংবদন্তির ঘেরাটোপে বন্দী। তবু যেটুকুর তল খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে বোধ হয় যে তিনি এক বিদুষী জ্যোতিষী, স্বামী মিহিরও একই বৃত্তিধারী। শ্বশুর যশস্বী জ্যোতিষী বরাহ মিহির। পুত্রজায়ার যশ, খ্যাতি ও বিদ্যার প্রভাব দর্শনে বরাহের হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষা। শ্বশুরের নির্দেশে লীলাবতীর জিহ্বা কর্তন ও তাঁর ‘খনা’ হয়ে ওঠার গল্প পেরিয়েছে প্রজন্মের সীমানা।
খনার বচনের মাঝে টিকে থাকা শত বছর আগের জল, মাটি, ফসল আর মানুষের গন্ধমাখা জ্ঞান আর সত্যটুকু কি সত্যি লীলাবতীর নাকি এ সত্য-তথ্য সবই এ ভূখণ্ডের বৃষ্টি, পলি আর জল হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা যুগান্তরের সামষ্টিক জ্ঞানের সংকলন? লীলাবতী শুধুই কি একজন নারী বলে তাঁর পরিণতি নির্মম? খনার সত্য শুধু থেকে যায় কৃষকের মুখে। তবু প্রশ্ন থাকে, খনার সত্যই কি একক সত্য? নাকি আজকে নির্ভুল যা, কাল তা হতে পারে অসত্য? শুধু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর যে মৃত্যু নেশা তাঁর, সে নেশা কি একরোখা জেদ? খনা নিজেই নিজেকে করেন সম্মুখীন প্রশ্নের। নাটকে এসব প্রশ্নই উঠেছে বারবার।