‘ডিটোম’ লাল কাঁকড়ার ধারালো দুটি পা...

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেল আয়োজিত সমতল ও পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ অনুষ্ঠানে মান্ওয়া নাট্যদলের নাটক ‘ডিটোম’–এর একটি দৃশ্যপ্রথম আলো

‘ডিটোম’ সাঁওতালি শব্দ, অর্থ লাল কাঁকড়ার ধারালো দুটি পা। কাঁকড়া পা দুটি দিয়ে প্রতিপক্ষের দেহের যেকোনো অংশ ধরলে কাঁকড়ার ওই অংশই ছিঁড়ে যাবে, তবু ধরে রাখা চামড়ার ওই অংশ না তুলে সহজে ছুটতে চায় না কাঁকড়া। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে সাঁওতালদের প্রতি ব্রিটিশ জমিদার ও শাসকগোষ্ঠীর আচরণও ঠিক এমনই ছিল। তাদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সংগ্রাম তুলে ধরতেই মঞ্চস্থ হলো ডিটোম। গতকাল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে এ নাটকের মঞ্চায়ন হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেল আয়োজিত ‘সমতল ও পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ’ অনুষ্ঠানে ছিল এ নাটক। গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাটের মান্ওয়া নাট্যদল প্রযোজিত ‘ডিটোম’ নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন কর্নেলিউস হাঁসদা।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, সমবেত গ্রামবাসী সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছেন
প্রথম আলো

নাটকের প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, সমবেত গ্রামবাসী সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছেন। এরপরের দৃশ্যে একটি সুখী পুরোহিত পরিবারের চরিত্রদের দেখা যায়। তারা বনের পশু শিকার করে, বনজঙ্গল কেটে আবাদি জমি তৈরি করে এবং ফসল চাষ করে। উপার্জন ও শিকারের আনন্দে উচ্ছাস, বিনোদন—সব মিলে তাদের যাপিত জীবন। এরই মধ্যে জমিদার ও ইংরেজরা এসে তাদের জমির কাগজ দেখতে চায়। ইংরেজদের দোসর হীরক সবার কাগজ পরখ করে। সে বৃদ্ধ পুরোহিতের কাগজ ছুড়ে ফেলে দেয়। পুরোহিত সেই কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইংরেজ সাহেবের কাছে যায়। সাহেব তাকে মাটিতে ফেলে সবার সামনেই গুলি করে হত্যা করে। এরপরেই শুরু হয় সিধু কানুর আন্দোলন–সংগ্রাম। নাটক জমে উঠতে সময় লাগে না।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেল আয়োজিত সমতল ও পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ অনুষ্ঠানে মান্ওয়া নাট্যদলের নাটক ‘ডিটোম’–এর একটি দৃশ্য
আবুল কালাম আজাদ

মঞ্চে তখন আন্দোলন। ‘হুপুচ হুপুচ য়া, দেলাং দেলাং য়া’, অর্থাৎ চলো চলো এগিয়ে চলো, মানব না মানব না—এই স্লোগানে দুর্বার হয়ে ওঠে আন্দোলন। বলে নেওয়া ভালো, নাটকের বেশির ভাগ সংলাপ সাঁওতালি ভাষায়। শুধু দৃশান্তর ত্রিলোক ও নন্দিনী সূত্রধরের ভূমিকায় বাংলায় ধারা বর্ণনা করেন। বাঙালি দর্শকদের একটুও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সিধু কানুর এই লড়াই সংগ্রামের জীবনগাথা।

নাটক জমে উঠতে সময় লাগে না
প্রথম আলো

সাদাপোশাকে কিছু বাউলের দেখা মেলে, গলায় ছিল দোতারা আর নন্দিনীর হাতে ছিল একতারা। তাদের বর্ণনায়, বীরভূম জেলার সাঁওতালরাই সংখ্যায় বেশি ছিল। ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতির জীবনধারার সঙ্গে এই সাঁওতাল সমাজজীবনের সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক ছিল। জীবিকার জন্য তারা পশু–পাখি শিকার ও জঙ্গল কেটে আবাদি জমি ও বসতি স্থাপন করত। কিন্তু এমন সারলিক জীবন ধারণ সহ্য হলো না সে কালের জমিদার, ব্রিটিশ কোম্পানি ও সরকারি কর্মকর্তাদের। ১৭০৪ সালে প্রথম জমিদারের শামিল হওয়ার পর থেকে শুরু হলো অন্যায়–অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘাটোয়ালদের বিদ্রোহ। অসংখ্য সান্তাল ও অন্য আদিবাসীদের অংশগ্রহণের পর ১৮১৪ সালে এ বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটল।

আরও পড়ুন

এরপর প্রায় ৩৬ বছর পর জমিদারি রদবদলে নতুন জমিদারেরা সেসব জায়গাজমি বাজেয়াপ্ত করে নিল। একপর্যায়ে জমিদারেরা খাজনা বাড়িয়ে দ্বিগুণ হারে শুরু করল প্রজাদের ওপর নির্মম নির্যাতন। সিধু ও কানু মুর্মুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জমিদার আর ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত সিধু ঘোষণা দেন, ‘জীবজন্তু শিকার করে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে আমরা এই এলাকায় জমি তৈরি করেছি, আমরা এখানে ফসল ফলাই, ওই জমিদার-ইংরেজদের দেওয়ার জন্য নয়। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’ বিদ্রোহীরা নানা দলে ভাগ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ব্রিটিশ ও জমিদার বাহিনীর হাতে প্রাণ দিল হাজার হাজার বিদ্রোহী। অবশেষে ১৮৫৬ সালে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে প্রাণ দিলেন সান্তাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা কানু মুর্মু।

নাটকের দৃশ্যে বাউল
প্রথম আলো

এরপরের দৃশ্যে দেখা যায়, সিধু নদীতে হাত-মুখ ধুচ্ছেন। তিনি ডানে–বাঁয়ে খেয়াল করেন না। পেছন থেকে জমিদারের লোক দুটি রশি নিয়ে এসে তাঁকে পেঁচিয়ে ফেলে। বীর লড়াই করেও এই দড়ির প্যাঁচ থেকে আর বের হতে পারেন না। ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে পাগলপ্রায় সিধু মুর্মুও ধরা পড়েন তাদের হাতে এবং তাঁকে লাখ লাখ জনতার সম্মুখে নির্মমভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। সিধু কানু প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাঁচার মানে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেল আয়োজিত সমতল ও পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ অনুষ্ঠানে মান্ওয়া নাট্যদলের নাটক ‘ডিটোম’–এর একটি দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

এ সময় গ্রামবাসী একটি গানে তাদের আহাজারি করে, ‘সিধু কানু চালাইয়া গেল রে আমারে মাড়ি করাইয়ে। দেখো দেখো আতুকু জালাইয়া গেল রে...অর্থাৎ সিধু কানু চলে গেল রে জমিদারেরা গ্রাম পুড়ায়ে গেল রে।’

নাটকের শেষ দৃশ্যে ত্রিলোক এসে এই ঘোষণা দিলেন, বঙ্গদেশের নানা শ্রেণির মানুষের ভেতর থেকে রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি বহু দিকপাল আবির্ভূত হয়েছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা সমাজ সংস্কারে বিভিন্ন দিকে নতুন নতুন আদর্শ স্থাপন করে চিরস্মরণীয় হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই নিজেদের গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তম জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেননি। তাঁদের কার্যকলাপ ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নিজস্ব শ্রেণির ভেতর সীমাবদ্ধ। তাঁরা এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াননি। সাঁওতাল ও সব মেহনতি মানুষ সেদিন বিদেশি রাজ্যের সামরিক শক্তির কাছে মাথা নত করেননি, বরং বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। এরই মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি ঘটে।

নাটকে বিপুল দর্শকের উপস্থিতি ছিল
ছবি: আবুল কালাম আজাদ

নাটকটির সহকারী নির্দেশক ছিলেন মারকুশ মুর্মু ও মিখায়েল সরেন, পোশাক–পরিচ্ছদে অনিল টুডু ও হাসিনা টুডু, কোরিওগ্রাফি করেছেন হাসিনা টুডু, আলোকসজ্জায় মিখায়েল সরেন, মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় মারকুশ মুর্মু ও জয়েন মুর্মু। নাটকে নাইকি চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৈলাস হাঁসদা, নাইকি কিমিন চরিত্রে নিলা হাঁসদা, নাইকি হপন চরিত্রে পলাশ হাঁসদা, ওঝা গুরু কৈলাস হাঁসদা, সুবল যাকোব সরেন, সুখি দিপালী মার্ডী, বুকড় চরিত্রে কৈলাস হাঁসদা, সিধু মাইকেল সরেন, কানু মিলন সরেন, চুন্ড তারসিশিউস মুর্মু, চাঁদ পলাশ হাঁসদা, কানু মিলন সরেন,মোড়ল সিলাস মুর্মু, ম্যাজিস্ট্রেট মারকুশ মুর্মু, জমিদার অনিল টুডু,মেজর স্টুয়ার্ড মারকুশ মুর্মু, হিরক মিখায়েল সরেন, নায়েব সুজন সরেন, দারোগা কৈলাশ হাঁসদা, পুলিশ-১ সুমন হাঁসদা, পুলিশ ২ সুজন সরেন, নন্দিনী চরিত্রে সোনালী হাঁসদা, ত্রিলোক ডেভিড সরেন, গ্রামবাসী রোজিনা হাঁসদা, সাথি হাঁসদা, আঁখি মার্ডী, মোমিতা মুর্মু প্রমুখ।