‘কম্পানি’: সুবে বাংলার ইতিহাসের পাতায় অবাক পৃথিবীর খোঁজ

আরণ্যকের নতুন নাটক ‘কম্পানি’র শেষ দৃশ্যে নির্দেশক ও নাট্যকার মামুনুর রশীদ মঞ্চে আসেন, তিনি একজন শিল্পপতির চরিত্রে অভিনয় করেছেনছবি: মাসুম অপু

সিরাজউদ্দৌলা নয়। মীর জাফর নয়। এমনকি এই নাটকের অনেকটা জুড়ে থাকা রবার্ট ক্লাইভও নয়। মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় আরণ্যকের নতুন নাটকের নাম ‘কম্পানি’। ব্যক্তিকে না এড়িয়ে সমষ্টিকে নাট্যকেন্দ্রে রাখা মামুনুর রশীদের নাটকের বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিমানুষের যতই গালভরা নাম থাক বা তাকলাগানো সিলমোহর থাকুক, সে যে আসলে ইতিহাসের পটে লেখা কেবলই ছবি এক, এই মতাদর্শকে কবচকুণ্ডলের মতো বুকে বেঁধে নাটককে শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার করে তুলেছেন মামুনুর রশীদ। এ কথা মাথায় রেখেও ‘কম্পানি’তে যে মামুনুর রশীদকে পাওয়া যাচ্ছে, তাঁকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

আরও পড়ুন

তার আগে ফয়সালা হোক, কিসের কোম্পানি? ১৬০০ সালে রানি এলিজাবেথের আমলে, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের নাকের ডগায় তৈরি হওয়া যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্রেফ সুবে বাংলা নয়, তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছে, একটু একটু করে কৃষিপ্রধান নদীমাতৃক অথচ শিল্পসম্ভাবনাময় একটি ভূখণ্ডকে নিংড়ে চুষে–ছিবড়ে করে আঁটি বানিয়ে ছেড়েছে, যার ভূত কিছুতেই আমাদের ঘাড় থেকে নামেনি, উপরন্তু ভোল পাল্টে হামেশা আমাদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে, সেই ‘কম্পানি’।

‘কম্পানি’র নাটকের শুরুর দিকের দৃশ্য
প্রথম আলো

কয়েক বছর আগেই ‘কহে ফেসবুক’ নাম দিয়ে করপোরেট কালচারের আলোতে-আঁধারে নজর দিয়েছিলেন মামুনুর, ‘কম্পানি’ যেন তারই পূর্বসূরি। ২৬৭ বছর আগে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর মাঠে আর মুর্শিদাবাদের মাটিতে যুগান্তকারী যে পরিবর্তনের সূচনা, তার জের যে আমরা সমানে টেনে চলেছি এবং একটির বদলে এখন হাজারো পুঁজিবাদী শক্তির সুতোর টানে মজে থেকে সোনার বাংলার লুটের বখরার বাঁটোয়ারা করছি, মামুনুর রশীদ আমাদের এই উপলব্ধির মূলে পৌঁছে দিতে চান।

নাটকের দৃশ্য
প্রথম আলো

কে না জানে, আমাদের জানা ইতিহাসে অনেক ফাঁকফোকর আছে। জমানা বদলে গেলে ইতিহাসের বয়ান বদল—এ–ও এক দস্তুর। এই অদলবদলের দরুন কত তিল থেকে তাল হয়, চাপা পড়ে যায় কত জীবন্ত জীবাশ্ম। ইতিহাসের মার্ক্সবাদী পাঠকে বুকে ধরে সুবে বাংলায় বণিকের মানদণ্ডের রাজদণ্ড হয়ে ওঠার পর্বে আমাদের নজর ঘুরিয়েছেন মামুনুর রশীদ।

দেড় শ বছর ধরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে বিগ্রহবিলাসী বাঙালি যে কবিকাহিনি ফেঁদেছে, তাকে সরিয়ে রেখে রক্তমাংসের এক নবাবকে (সাজ্জাদ সাজু) মঞ্চে এনেছেন। ক্লাইভকে (শাহারান) তুলে এনেছেন ইয়র্কশায়ারের জেলখানা থেকে। এই দুই ক্ষমতাকেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সে আমলের দুঁদে ব্যাংকার জগৎশেঠ (কামরুল হাসান), কাশ্মীর থেকে বাংলায় এসে নবাবের আস্থাভাজন হয়ে ওঠা সেনাপতি মোহনলাল (সাঈদ সুমন), ফরাসি গোলন্দাজ সিনফ্রের (প্রিন্স রাশীক) মতো অগণন চরিত্র। ঘসেটি বেগমের (লায়লা বিলকিস ছবি) মতো কেউ একবার জ্বলে উঠে নিভে গেছেন। ‘কম্পানি’ হয়ে উঠেছে সাহেবদের খপ্পরে পড়ার সময়কার বাংলার এক বহুমাত্রিক ও বহুভাষিক দলিল।

মহড়ায় নির্দেশক মামুনুর রশীদ। ছবি: দীপু মালাকার

দলিল; কারণ, নাট্যকার খুবই সন্তর্পণে তথ্যের ভার আড়াল করলেও আগাগোড়া তথ্যনিষ্ঠ থেকেছেন। বহুভাষিক; কারণ, বাংলার পাশাপাশি অনর্গল ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, এমনকি টুকরোটাকরা ফরাসিও শুনেছি আমরা। ঠোক্কর বাঁধেনি। কতক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ঢঙে সিরাজের কাছেপিঠে কিছু মনগড়া চরিত্র রেখেছেন মামুনুর রশীদ। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর দৌলত খাঁ (আরিফ হোসেন আপেল) আর জহরত বাই (রুবলী চৌধুরী)। দুজন আমাদের মনে করিয়েছেন যে নবাবি বাংলার সরকারি জবান ছিল বাংলা নয়, ফারসি। আমাদের অচেনা এই ফারসি আন্দাজের গানবাজনার দৌলতে কম্পানির ধ্বনিজগৎ এক অনায়াস বহুমাত্রিকতা পেয়েছে, যা আমাদের গৎবাঁধা জীবনের বাইরে তাকানোর ইন্ধন দিয়েছে। হারানো মগবাজার কিংবা আরমানিটোলার ঠিকানাও মনে করিয়েছে।

দেড় শ বছর ধরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে বিগ্রহবিলাসী বাঙালি যে কবিকাহিনি ফেঁদেছে, তাকে সরিয়ে রেখে রক্তমাংসের এক নবাবকে (সাজ্জাদ সাজু) মঞ্চে এনেছেন
প্রথম আলো

পরিমল মজুমদারের মতো অভিজ্ঞ সংগীত পরিচালক উইংসের ধারে থাকায় এই মাল্টিভার্স আমাদের নাগালে আসতে অসুবিধা হয়নি। বিশেষ করে ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে আসা ‘লুট লিয়া’ হাহাকার আমাদের মগ্ন চৈতন্যে ঘা দিয়েছে। ফয়েজ জহিরের মঞ্চভাবনায় অনুভূমিক ও উল্লম্ব রেখার মিলমিশ যাতে আমাদের চোখে পড়ে, তার জন্য আলোক পরিকল্পক ঠান্ডু রায়হান সজাগ ছিলেন। তাঁর কালার প্যালেটে, লাইট সোর্সের বাছাইয়ে যে ইচ্ছাকৃত সেকেলেপনা, সেটি আমাদের মনে ধরেছে।
অনেক খণ্ডদৃশ্যের সমন্বয়ে তৈরি এই নাটকের কাঠামো তুলনায় সেকেলে হলেও এর রকম যত না ড্রামাটিক, তার চাইতে ঢের বেশি সিনেম্যাটিক।

নাটকের দৃশ্য
প্রথম আলো

মধ্যান্তরের আগে মনে হচ্ছিল, বুঝি ওয়েব সিরিজ বানাতে বসে কী ভেবে যেন নাটক বানিয়ে ফেলেছেন পোড় খাওয়া মামুনুর। জাতীয় নাট্যশালার পেল্লাই ওপেনিংকে দরকারমাফিক আঁটসাঁট করে নিয়ে কিংবা খুলে দিয়ে অন্দর আর বাহিরের টানাপোড়েন চেনানোর মধ্যে তাঁর ওস্তাদি আছে। ওস্তাদি আছে আপাতচেনা মানুষের অচেনা দিকে আলো ফেলার কায়দায়। খামতি কিছু আছে, যেমন ইয়র্কশায়ার জেলের ইয়াব্বড় দৃশ্যের গড়নে। উপক্রমণিকা হিসেবে এটি জরুরি হলেও কিঞ্চিৎ মেরামত ও কাটছাঁটের প্রত্যাশী। বরং উপসংহারের দৃশ্যটি, যেখানে খোদ মামুনুর রশীদ মঞ্চে আসেন ধনকুবেরের সাজে, মৌলবাদের মধ্যে পুঁজিবাদের দোসর চিনিয়ে দেন, সেটি প্রলম্বিত হলে আমাদের আশ মেটে।

অংশুমান ভৌমিক, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার ও নাট্য সমালোচক