রাজার চোখে অন্য দৃষ্টি

রাজনেত্র নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: আরণ্যকের সৌজন্যে

প্রায় প্রতিদিনই নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে। নতুন নাটক নিয়ে আসছে নতুন দলগুলো। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোও নিয়ে আসছে নতুন নাটক। চলছে মহড়া। সব মিলিয়ে মুখর নাটকপাড়া। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে নাটকের দল থিয়েটার নিয়ে এসেছিল নতুন নাটক ‘পোহালে শর্বরী’। মাসের শেষ সপ্তাহে, অর্থাৎ আজ শুক্রবার থিয়েটারের সমবয়সী নাটকের দল আরণ্যক আনছে নতুন নাটক ‘রাজনেত্র’। সব মিলিয়ে যেন শ্রাবণসন্ধ্যায় সমকালীন বাংলা নাটকের মহা আয়োজন।
স্বাধীনতার পরপরই ১ ফেব্রুয়ারিতেই আরণ্যক নাট্যদল গঠন করেন সে সময়ের কয়েকজন নিবেদিত তরুণ নাট্যকর্মী। নামটি দিয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল-মামুন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘টেলিভিশন সেন্টারে আমি, আলী যাকের আর আবদুল্লাহ আল-মামুন গল্প করছিলাম। বলেছিলাম, “একটা নাটকের দল করব, কী নাম দেওয়া যায়?”আবদুল্লাহ আল–মামুন বললেন, “নাগরিক তো আছেই, তোমরা আরণ্যক হয়ে যাও।” তারপরই নাম দিলাম “আরণ্যক”।’সেই থেকে নিরবচ্ছিন্ন নাট্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে আরণ্যক নাট্যদল। মঞ্চে, পথে, মিছিলে কিংবা স্লোগানে আরণ্যক নাট্যদল সব সময় শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে আসছে।’

এ বছর আরণ্যক নাট্যদল তাদের গৌরবময় ৫০ বছর পার করছে। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী নানা আয়োজন হাতে নিয়েছে নাট্যদলটি। তারই ধারাবাহিকতায় আরণ্যক মঞ্চে আনছে নতুন প্রযোজনা ‘রাজনেত্র’।

রাজনেত্র নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: আরণ্যকের সৌজন্যে

হারুন রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হবে আজ সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মূল মিলনায়তনে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ নাটকের মহড়া শুরু হয়েছে। প্রায় পাঁচ মাস মহড়া শেষে গত দুই দিন পরপর দুটি কারিগরি প্রদর্শনী হয়েছে।
গত বুধবার আরণ্যকের প্রধান নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, ‘রাজনেত্র’ তাঁদের ৬৪তম প্রযোজনা, যার গল্প সমকালীন নয়; বরং ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ের। অনেক বছর আগের এক রাজার গল্প। বিত্তবৈভব, ভোগবিলাস আর শাসনের ঘেরাটোপে বন্দী এক রাজা। যেখানে তিনি রাজ্যকে এক চোখে দেখেন আবার তাঁর রাজ্য ও রাজ্যের মানুষকে দেখেন অন্য চোখে। এই দুই দেখায় আকাশ-পাতাল তফাত। তবে তিনি দেখেন না বলে বলা যায়, তাঁকে দেখানো হয়। একসময় রাজা বোঝেন বটে, কিন্তু রাজ উপনেত্র তাঁকে প্রজাদের আসল অবস্থা দেখতে দেয় না। রাজা এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চান। খালি চোখে দেখতে চান রাজ্যকে, রাজ্যের মানুষকে। সভার অন্যরা রাজাকে সাবধান করে দেন, খালি চোখে প্রজাদের দেখলে রাজ্যহারা হবেন রাজা। নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে রাজপ্রাসাদের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। কার্যত বন্দী করে রাখা হয়।

নাটকের একপর্যায়ে রাজাকে প্রাসাদপ্রাচীরে ব্যস্ত রাখতে চক্রান্ত করে বিশাখা নামের একজন প্রান্তিক নারীর সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিশাখা রাজাকে বুঝতে চেষ্টা করেন। রাজা যখন তাঁর কাছে জীবনের স্বাভাবিকতা দেখার আর নিজের চোখ দিয়ে প্রজাদের দেখার আকুতি জানান, রাজার প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দেন বিশাখা। তাঁর হাতে হাত রেখে রাজা চলে যান প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে। কিন্তু যথারীতি রাজ উপনেত্র ছাড়া রাজার জনপদে যাওয়া এবং খালি চোখে মানুষকে দেখা মেনে নেন না রাজার আমত্য ও পারিষদরা। ক্ষমতাচ্যুত করে রাজার স্থলাভিষিক্ত হন নতুন রাজা।
সব মিলে নাটকের বক্তব্যটা এমন, ক্ষমতাসীনরা রাজ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কখনো স্বাভাবিক চোখে দেখে না, দেখে শাসনের উপনেত্র দিয়ে। ক্ষমতার পালাবদল হয়, কিন্তু সবার চোখে থাকে একই রাজনেত্র।

রাজনেত্র নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: আরণ্যকের সৌজন্যে

দলের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে নতুন নাটকটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে আরণ্যকের কাছে। যেখানে নবীন–প্রবীণ কর্মীদের উপস্থিতি আছে। রীতিমতো কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সব সদস্য।

নাটকটির নির্দেশক হারুন রশীদ বলেন, ‘আমার নাট্যচর্চার বয়স ৪৫ পেরোলেও নির্দেশক হিসেবে আমাকে শিক্ষানবিশ বলা যায়। একজন শিক্ষানবিশ পরিচালক রাজনেত্রর মতো একটি বৃহৎ আঙ্গিকের নাটক নির্দেশনা দিতে পেরেছে; কারণ, মামুনুর রশীদের মতো একজন নাট্যকার, শিল্পী ও শিক্ষক হলেন আরণ্যকের প্রাণপুরুষ।’ নির্দেশকের ভাষায়, ‘মানুষকে মানবিক বোধে উদ্দীপ্ত করতে, সাম্য ও সমতার নিশ্চয়তার জন্য স্বপ্ন দেখাতে নাটক যে কী দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে, আরণ্যক নাট্যদলে কাজ না করলে আমি তা বুঝতেই পারতাম না।’

মহড়া কক্ষে ‘রাজনেত্র’

এ মাসে বেশ কয়েকটি নতুন নাটক যোগ হলো ঢাকার নাট্যাঙ্গনে। থিয়েটার যেমন এনেছে নতুন নাটক, তেমনি লোক নাট্যদল নতুন করে মঞ্চস্থ করেছে তপস্বী ও তরঙ্গনী। থিয়েটার আর্ট ইউনিট মঞ্চস্থ করেছে নতুন নাটক ‘মাধব মালঞ্চী’। সব কটি প্রদর্শনীতে ছিল দর্শকের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। আজ পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে নাটক ‘শাস্তি’র শততম মঞ্চায়ন করবে স্বরবীথি থিয়েটার। সব মিলিয়ে শীতের আগে বর্ষাতেই ঢাকার মঞ্চাঙ্গন জমে উঠেছে বললে খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না।