তাঁর ‘আলী যাকের’ হয়ে ওঠা

জাতীয় নাট্যশালায় পদাতিক নাট্য সংসদের স্মারক সম্মাননা অনুষ্ঠানে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, পদকপ্রাপ্ত সৈয়দ শামসুল হক, আলী যাকের ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো

করুণ সুরে বিউগল বেজে ওঠে। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকেরকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশকে পুনর্গঠনে যাঁরা কাজ করেছিলেন, আলী যাকের তাঁদের অন্যতম। পরের প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য যেসব মানুষ কাজ করেছিলেন, যাকের তাঁদের অন্যতম। দেশকে স্বাধীন একটি নাট্যাঙ্গন দিয়েছেন যাঁরা, আলী যাকের তাঁদের অন্যতম। তাঁর জন্য শ্রদ্ধার শেষ থাকবে কেন! তবু তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাঙালি। কর্মমুখর আলী যাকেরের পেছনের জীবন জানা নেই অনেকেরই।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নিবেদিত গ্যালিলিও নাটকের একটি দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের ও কাওসার চৌধুরী।
ছবি: প্রথম আলো

আলী যাকেরের বাবার ছিল বদলির চাকরি। পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে হলেও বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কাজে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে থাকে তাঁদের পরিবার। আলী যাকেরের প্রথম স্মৃতি ফেনীতে। সেন্ট গ্রেগরি থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন নটর ডেমে, সেখান থেকে পাস করলেন ১৯৬২ সালে। পরে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেন। তখনই যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতিতে, করতেন ছাত্র ইউনিয়ন। স্নাতক শেষ হওয়ার পর ১৯৬৭ সালে চলে যান করাচি। সেখানেই করেছিলেন প্রথম অভিনয়। সেখানকার জাহাঙ্গীর কোর্টে থাকতেন ছোট-বড় সরকারি আমলারা। বাঙালিদের সংখ্যাও কম ছিল না। সেখানেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলী যাকের গেলেন ভারতে, নিলেন প্রশিক্ষণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তখন একটি ইংরেজি সার্ভিস চালু করে। সেখানেই কাজ শুরু করেন তিনি, প্রচারণা চালিয়েছেন, হয়েছেন শব্দসংগ্রামী।

অনুষ্ঠানস্থলে স্ত্রী সারা যাকেরকে নিয়ে অভিনেতা আলী যাকের। ছবি: আবদুস সালাম

মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আলী যাকের যোগ দেন আরণ্যক নাট্যদলে। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ওই বছরেরই জুন মাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। তখন থেকে নাগরিকই তাঁর ঠিকানা। ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক মঞ্চসফল নাটকের নির্দেশক, নয়তো অভিনেতা ছিলেন তিনি। বিশ্বখ্যাত সব মঞ্চনাটক রূপান্তর করেছেন। মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও পেয়েছিলেন বিপুল জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনে ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এ ছাড়া ৫০টির বেশি বেতার নাটক করেছেন তিনি। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও করেছেন অভিনয়। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন, বেরিয়েছিল বই, যার মধ্যে আছে ‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’। আলী যাকের শখ করে ছবিও তুলতেন।

আলী যাকের ছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি, যুক্তরাজ্যের রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, পুত্র ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রেয়া সর্বজয়া, পুত্রবধূ মিম রশিদ, নাতনি নেহাকে নিয়ে তাঁর সংসার। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি।

কিছুটা সুস্থ থাকাকালে নাতনি নেহাকে কোলে নিয়ে সময় কাোতেন আলী যাকের। ছবি : সংগৃহীত