থিয়েটারের জন্য মলয় ভৌমিকের ত্যাগ অফুরন্ত
১ মে নাট্যকার মলয় ভৌমিকের জন্মদিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবিতে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মলয় ভৌমিক জন্মদিনের সব আয়োজন এড়িয়ে চলেন। তবু গত বছর এই দিনে অন্তর্বর্তী থিয়েটারের কাগজ ‘আনর্ত’ মলয় ভৌমিককে নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করে। এটির সম্পাদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক রহমান রাজু। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী রানা ধর ও শমীন্দ্র ভৌমিক। এতে ৯১টি স্থিরচিত্র ও দুই বাংলার ৬৬ জন লেখকের লেখায় মলয় ভৌমিকের জীবন, নাট্যনির্মাণ ও চর্চার প্রসঙ্গটি বিশদভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে ও করোনা পরিস্থিতির কারণে ‘আনর্ত’র ৪৮০ পৃষ্ঠার এ সংখ্যার প্রকাশনায় কোনো আড়ম্বর করা হয়নি। এই নাট্য সাধকের জন্মদিন উপলক্ষে এ লেখায় ‘আনর্ত’র আয়নায় তাঁকে ফিরে দেখার চেষ্টামাত্র।
সম্পাদক রহমান রাজু লিখেছেন, ‘মলয় ভৌমিক নাটক লিখেছেন ২৫টি। নির্দেশনা দিয়েছেন ৩৫টি। সংগঠন চালিয়েছেন ৪১ বছর। অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও টিভি উভয় মাধ্যমে। সাংবাদিকতা করেছেন। লিখেছেন কলাম। কিশোরবেলায় অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে। নাট্যসাহিত্যে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। তিনি মূলত নাট্যশ্রমিক-নাট্যপ্রাণ মানুষ। হামলা-মামলায়ও থিয়েটার ছাড়েননি। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাবরই আপসহীন। যুক্ত ছিলেন মুক্তি নাট্যদলের সঙ্গে। অংশ নিয়েছেন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রভাগে তৈরি অগণিত নাট্যকর্মী-স্বকর্মে যাঁদের অনেকেই নাট্যজনরূপে প্রতিষ্ঠিত। মলয় ভৌমিকের মতো এমন নাট্যজনপ্রাণ বাংলাদেশে অনেকেই আছেন, কিন্তু উত্তরাঞ্চলে তিনি দৃষ্টান্ত নাট্য সাধক। থিয়েটারের জন্য তাঁর ত্যাগ অফুরন্ত। তাঁর নাটকের বিষয় ও নির্মাণপ্রচেষ্টায় প্রান্তবর্গীয় ও ঐতিহ্যিক ব্যাপারটি পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
তিনি বলেছেন, সংখ্যাটিতে পরিপূর্ণ মলয় ভৌমিককে পাওয়া যাবে এমনটি নয়; বরং সংখ্যাটি একটি প্রাথমিক অন্বেষণ সূত্রের দাবি করতে পারে। নিশ্চয় পাঠান্তে নানা রকম জিজ্ঞাসার জন্ম হতে পারে। বোধ করি, ওই জিজ্ঞাসার জন্ম দেওয়াটাই এই সংখ্যার প্রাপ্তি...।’
নিজের লেখায় মলয় ভৌমিক বলেছেন, ‘বাংলার বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়ার বংশধর আমি। আমাদের মূল পদবি বাগচী। ভৌমিক পদবি এসেছে ওই ভূঁইয়া থেকেই। ভূঁইয়া আর ভৌমিক একই অর্থ। ভারতবর্ষের হাঙ্গার স্ট্রাইকের সঙ্গে যুক্ত শচীন ভৌমিক ও ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলনের অহীন্দ্র ভৌমিক আমার কাকু। বাবা শিবেন্দ্রনাথ ভৌমিক, মা নিয়তি ভৌমিক।’ বলেছেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি যখন নাটকের দলে কাজ করি, নাটক নির্দেশনা দিই, যাদের নিয়ে কাজ করি, তারা কাজটা উপভোগ করে কি না, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে তা আনন্দের হয়ে ওঠে কি না, সেটাই হচ্ছে আমার প্রথম বিবেচনা।’ এতে ‘কাছের মানুষ’ শিরোনামে লিখেছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। এখানে মনোজ মিত্রের ‘গল্প হেকিম সাহেব’ নাটকে মলয় ভৌমিকের সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের অভিনয়ের একটি স্থিরচিত্র রয়েছে।
‘অবিরাম আপসহীন: নান্দনিক’ শিরোনামে লিখেছেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। এখানেও বাঙলা থিয়েটার প্রযোজিত ‘লেবেদেফ’ নাটকের একটি স্থিরচিত্রে মামুনুর রশীদ ও মলয় ভৌমিককে দেখা যায়। মাসুম রেজা লিখেছেন ‘মলয় ভৌমিক: এক ছায়াবৃক্ষ’ শিরোনামে। নাট্যকার এস এম আবু বকর লিখেছেন ‘মলয় ভৌমিকের নাটকের সারবত্তা নিখাদ দর্শন’ শিরোনামে।
অলোক বসু একটি কবিতা লিখেছেন। তার শেষ কটি চরণে তিনি বলেছেন—
‘মলয় ভৌমিক
আপনাকে আমার চেনা শেষ হবে না
আপনি আপনার কর্মগুণে, নাট্যগুণে
আমাদেরকে চিনিয়ে দেবেন আপনাকে
মলয়বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার মতো
আপনারই কাঙ্ক্ষিত স্বদেশে।’