‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ পদ্ধতিতে নাটক হচ্ছে: চঞ্চল চৌধুরী

চঞ্চল চৌধুরী
খালেদ সরকার

২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। আর টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে চঞ্চল চৌধুরীর ‘মুখ দেখানোর’ ২৫ বছর পূর্তি হবে। প্রতিদিন মানুষ প্রশ্ন করে, আগের মতো সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল, জনপ্রিয় নাটক এখন কেন নির্মিত হচ্ছে না। এর উত্তরে ফেসবুকে ৭১৪ শব্দের একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন বড় ও ছোট পর্দার জনপ্রিয় মুখ চঞ্চল। এই লেখায় টেলিভিশন নাটক কোমায় পৌঁছে যাওয়ার প্রেক্ষাপট ও কারণ জানিয়ে সমাধানও দিয়েছেন তিনি।
স্ট্যাটাসের শুরুতে চঞ্চল হতাশার সুরে লিখেছেন, ‘আমাদের সিনেমার একটা সোনালি অতীত ছিল। কিছু অযোগ্য এবং স্বার্থপর লোকের আধিপত্যে আমরা সে অতীত হারিয়েছি। পরবর্তীকালে টেলিভিশন নাটক দেশের অধিকাংশ মানুষের সুস্থ বিনোদনের দায়িত্ব নেয়। আর আস্থা অর্জন করে। তবে কখনোই এই মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পেশাদারত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে টেলিভিশন নাটকও একসময় বাংলা সিনেমার মতোই কিছু সুবিধাভোগী অযোগ্য মানুষের দখলে চলে যায়।’

চঞ্চল চৌধুরী: ছবি: ফেসবুক

এরপর চঞ্চল লিখেছেন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে শিল্পের খোলস থেকে টেনে বের করে নাটককে শুধুই ব্যবসার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। অধিকাংশ চ্যানেল, এজেন্সি, প্রযোজক, পরিচালক, কলাকুশলী কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে টেলিভিশন নাটককে অখাদ্যে পরিণত করেছে।

একটি নাটকের দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

সস্তা জনপ্রিয়তা আর ভিউর মাপকাঠিতে শৈল্পিক নাটক চাপা পড়ে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার সমালোচনাও করেন চঞ্চল চৌধুরী। ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল বা নাটক ব্যবসায়ীরা ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসেছে। সেখানে ভিউ ব্যবসা বেশ জমেও উঠেছে। টেলিভিশন নাটককে শিল্পের মাপকাঠি থেকে বের করে এনে ভিউর মাপকাঠিতে মাপা শুরু হয়েছে। ভিউ আর টিআরপির চক্করে পড়ে আমরা আমাদের নাটকের মান কোথায় নামিয়ে ফেলেছি! ইদানীং ভালো টেলিভিশন নাটকের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে তা দিয়ে এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সবারই সমান দায় রয়েছে।’
গুণী এই অভিনেতা মনে করেন, শুধু ভিউ না দেখে, সংশ্লিষ্ট সবারই নাটকের মানটা দেখা অনেক বেশি জরুরি।

চঞ্চল চৌধুরী
প্রথম আলো

তিনি বলেন, ১০ বছর আগে নাটকের যে বাজেট ছিল, এখন তা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এই বাজেটেরও অর্ধেকটা চলে যাচ্ছে এজেন্সি, প্রডিউসার ও ডিরেক্টরদের পকেটে। বাকি বাজেট দিয়ে ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ পদ্ধতিতে নাটক হচ্ছে।

তিন দিনের কাজ এক দিনে করতে গিয়ে কলাকুশলীসহ সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। নাটকের গুণগত মান রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাতে করে অনেক যোগ্য শিল্পী বঞ্চিত হচ্ছেন। আর নাট্যকারেরা তো অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছেন। কারণ, তথাকথিত এসব নাটক নির্মাণ করতে কোনো স্ক্রিপ্ট লাগে না।

‘সাকিন সারিসুরি’ নাটকে জাপান ডাক্তার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
ছবি :সংগৃহীত

টেলিভিশন নাটকের দেয়ালে আসলে অনেক আগেই শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে বলে চঞ্চল আরও লেখেন, ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো টেলিভিশনের অসুখ বুঝতে পেরেছে। তারা সেভাবেই আগাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যারা ভালো কনটেন্ট দেবে, তারাই টিকে যাবে। ইতিমধ্যে ওটিটির একটা দর্শকশ্রেণি তৈরি হয়ে গেছে। তাই টেলিভিশনকে উঠে দাঁড়াতে হলে নতুন করে ভাবা খুবই জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা, যোগ্য মানুষ, যোগ্য বাজেটের বিকল্প নেই।’
এভাবেই সমাধান দিয়ে উপসংহারে বড় পর্দার ‘মিসির আলী’ চঞ্চল লেখেন, তিনি এত কথা লিখেছেন কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়। কেউ তাঁর কথায় দুঃখ পেলে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী তিনি। টেলিভিশন নাটককে ভালোবাসেন বলেই এসব নাটকের ভালো না থাকা তাঁকে পীড়া দেয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। স্ট্যাটাসটি শেষ করেছেন এভাবে, ‘আলোচনা সাপেক্ষে এই ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত অসুখ সারিয়ে তুললেই সুস্থ হয়ে উঠবে সব। বেঁচে যাবে আমাদের টেলিভিশন নাটক, বাঁচবে টেলিভিশন।’

‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রে চঞ্চল চৌধুরী।
ছবি :সংগৃহীত