দিনে শুটিং, রাতে পরিপাটি সংসার

বাড়তি আয়ের জন্য পুরান ঢাকায় সাজানো-গোছানো বাড়িকে শুটিংয়ের জন্য নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হয়তানভীর আহাম্মেদ

বুড়িগঙ্গার পাশঘেঁষা আলমগঞ্জের একটি পুরোনো বাড়ি। সরু একটি গলি ধরে এর দোতলায় উঠতে হয়। পাশাপাশি দুজন ওই গলি দিয়ে যেতে পারে না। দোতলায় উঠতেই একটা বড়সড় বারান্দার দেখা মিলল। বারান্দার ওপাশেই বুড়িগঙ্গা নদী। একটু এগোতেই বাঁ দিকে পাওয়া গেল বড় একটি রান্নাঘর, আর ডানে একটি দরজা। সেখানেই মুন্নি খাতুনের সঙ্গে পরিচয়। তাঁর সাজানো–গোছানো ঘর দেখে দ্বিধায় পড়তে হয়। অগত্যা প্রশ্ন করা, এই বাড়ির কোথায় শুটিং হয়? মুন্নি খাতুন নির্বিকার চিত্তে বললেন, এখানেই। কৌতূহল নিয়ে আবার জানতে চাইলাম, ‘তাহলে আপনারা থাকেন কোথায়?’ আবার সাদামাটা ভঙ্গিতে জবাব দিলেন তিনি, ‘শুটিং থাকলে আমরা পুরো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সবাই অন্য একটি রুমে চলে যাই।’ এভাবেই বাড়তি আয়ের জন্য সাজানো-গোছানো বাড়িকে শুটিংয়ের জন্য নিয়মিত ভাড়া দিয়ে আসছেন মুন্নি খাতুন। আলমগঞ্জের এই বাড়ি এখন ‘দারোগার শুটিংবাড়ি’ নামে পরিচিত।

সরু গলি ধরে বাড়ির দোতলায় উঠতে হয়
তানভীর আহাম্মেদ

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, নারিন্দাসহ বেশ কিছু এলাকায় এভাবেই গড়ে উঠেছে শুটিংবাড়ি। আদতে এগুলো একেকটি সাজানো–গোছানো সংসার। কোনোটিতে থাকে ছোট-বড় পরিবার। কোনো বাড়ি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। কোথাও থাকেন কর্মজীবী মানুষেরা। এই বাড়িগুলোর প্রতিটিই বেশ পুরোনো এবং ঢাকার পুরোনো সময়ের স্মৃতি মাখা। বাড়িগুলো আলাদা সৌন্দর্যে যেমন দৃষ্টিগ্রাহী, তেমনি ঐতিহাসিক প্রাচুর্যেও ভরপুর। সাহিত্য থেকে নেওয়া কিংবা পুরোনো যুগের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পের দৃশ্যায়নের জন্য নির্মাতাদের কাছে পুরান ঢাকার এ ধরনের বাড়ির রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এসব বাড়িতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা শুটিংয়ের সময় পুরো বাড়ি খালি করে দিয়ে পরিবারসহ আলাদা একটি ঘরে চলে যান। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১ পর্যন্ত শুটিং চলে। তখন পরিপাটি সংসার হয়ে ওঠে কর্মব্যস্ত শুটিংবাড়ি। এ সময়ে বাড়ির ভেতরের জিনিসপত্র হয়ে ওঠে শুটিংয়ের অনুষঙ্গ। এসব বাড়িতে ‘আয়নাবাজি’, ‘চোরাবালি’সহ বেশ কিছু আলোচিত ছবির শুটিং হয়েছে।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, নারিন্দাসহ বেশ কিছু এলাকায় এভাবেই গড়ে উঠেছে শুটিংবাড়ি
তানভীর আহাম্মেদ

শুটিংয়ের ধরনভেদে প্রতিটি বাড়ির ভাড়া নির্ধারিত হয়। নাটকের জন্য ১০ হাজার টাকা, চলচ্চিত্রের জন্য ১২ হাজার টাকা এবং বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের জন্য প্রতিদিন গুনতে হয় ১৫ হাজার টাকা। তবে সম্পর্কের খাতিরে ভাড়া কমবেশি হয়। শুটিংয়ের সময় ওই বাড়ির জামাকাপড় থেকে শুরু করে থালাবাসন, আয়না, দেয়ালে ঝোলানো পারিবারিক ছবি—সবই ব্যবহার করতে পারে শুটিংয়ের দল। বাড়ির খাট, সোফা, ডাইনিং টেবিল ইচ্ছামতো সাজিয়ে নিতে পারেন নির্মাতা ও কুশলীরা।

কিছু শুটিংবাড়িতে থাকেন কর্মজীবী মানুষেরা
তানভীর আহাম্মেদ

শুটিং শেষ হলে সেসব আবার গুছিয়ে রেখে যেতে হয়। দারোগার শুটিংবাড়ির দায়িত্বে থাকা মুন্নি খাতুন বলেন, ‘প্রায় দুই বছর আগে প্রথম একজন নির্মাতা বাড়িটি পছন্দ করেন। তিনি শুটিং শেষ করে কিছু টাকা দেন। তারপর থেকে বাড়িতে আরও অনেক নির্মাতাই শুটিং করতে চাইতেন। তখন থেকেই আমরা টাকার বিনিময়ে শুটিংয়ের জন্য বাড়ি ভাড়া দিতে শুরু করি।’ তিনি আরও জানান, এখন প্রায় প্রতিদিনই শুটিংয়ের জন্য বাড়িটির ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব আসে। তবে তাঁরা বাড়িতে একটানা তিন দিনের বেশি শুটিং হতে দেন না। মুন্নি খাতুন আরও জানান, এতে পরিবার নিয়ে থাকতে তাঁদের সমস্যা হয়। তাই সপ্তাহে দু-তিন দিন করে বিরতি রাখেন। মুন্নি খাতুনের সঙ্গে যেদিন কথা হচ্ছিল, সেদিনও চলছিল বিরতি। তারপরও দেখা গেল, বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলছে অভিনেত্রী দীপা খন্দকার ও তাসনিয়া ফারিনের ছবি। মুন্নি বললেন, শুটিং শেষ হলে সবাই শুটিংয়ের কিছু জিনিসপত্র ফেলে যায়।

মুন্নি খাতুনের ‘দারোগার শুটিংবাড়ি’র রান্নাঘর
তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকার কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস মঙ্গলাবাসেও নিয়মিত শুটিং হয়। এ ছাত্রাবাস পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের কাগজিটোলায় অবস্থিত। এখানকার ছাত্ররা নিয়মিত শুটিং দেখে অভ্যস্ত। তারকাদের সম্পর্কে নাজিম উদ্দিন নামের এক ছাত্র বলেন, কদিন আগেও এখানে আফরান নিশো ভাই শুটিং করে গেলেন। মোশাররফ করিম, জোভান, মেহ্‌জাবীন, ফারিনরাও শুটিং করতে আসেন। সবাই খুব ভালো, মিশুক।

‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের নারিন্দার বাড়িতেও শুটিং হয়। শুটিংয়ের মানুষের কাছে এ বাড়ি ‘বেগমবাড়ি শুটিং হাউস’ নামে পরিচিত। বাইরে থেকে অনেক পুরোনো মনে হলেও, এর ভেতরে গিয়ে যেতেই পাওয়া গেল নতুন রঙের ঘ্রাণ। শুটিং বাড়িটির দায়িত্বে থাকা রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘শুটিংয়ের মানুষ চাইলে বাসার রং নিজেদের প্রয়োজন মতো বদলাতে পারেন। তবে যে রং–ই করুক না কেন, কাজ শেষ করে আবার সাদা রং করে দিয়ে যেতে হয়। এ জন্য আমরা আট হাজার টাকা অগ্রিম রেখে দিই।’ এ বাসায় সম্প্রতি ‘পল্লব ভাই এক কাপ চা খাইবার চাইছিল’ নামের একটি নাটকের শুটিং করেছেন নির্মাতা সাগর জাহান। অভিনেতা ছিলেন জিয়াউল ফারুক অপূর্ব ও সাবিলা নূর। নির্মাতা সাগর জাহান বলেন, ‘উত্তরা, পুবাইলে কাজ করতে করতে যখন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, তখনই এ এলাকায় ২০১১ সালে ‘আরমান ভাই’ সিরিজ নাটকের শুটিং শুরু করি। তারপর থেকে অনেকেই এখানে শুটিং করছেন। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য তুলে ধরতেই কাজ করি। সেই চেষ্টাই থাকে।’

‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের নারিন্দার বাড়িতেও শুটিং হয়
তানভীর আহাম্মেদ