যাত্রাশিল্পে ধস, বিপাকে নারী মালিকেরা

পর্যাপ্ত যাত্রাগানের আয়োজন না থাকায় অধিকাংশ দলকেই বসে থাকতে হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
পর্যাপ্ত যাত্রাগানের আয়োজন না থাকায় অধিকাংশ দলকেই বসে থাকতে হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক বছর ধরে যাত্রাশিল্পে ক্রমে লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত যাত্রাগানের আয়োজন না থাকার কারণে অধিকাংশ দলকেই বসে থাকতে হচ্ছে। কালেভদ্রে দুই–একটা বায়না পেলে তাতে শিল্পী আর কুশীলবের বেতন ও অন্যান্য খরচ শেষে হাতে আর কিছুই থাকে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যাত্রাশিল্পে প্রতিযোগিতায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী মালিকেরা। অনেকে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন।

গোপালগঞ্জের নারী যাত্রাদলের মালিক মনীষা অধিকারী সাতপাড় বাজারে পারলার খুলে বসেছেন। যাত্রার কথা আর ভাবতেই পারছেন না। অথচ একসময় দলে নাচতেন ও অভিনয় করতেন। নেশাকে পেশা হিসেবে নিয়ে কয়েক বছর যাত্রার দল গঠন করে ঘুরেছেন দেশের আনাচকানাচে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের আয়েশা আক্তার টানা ১৮ বছর যাত্রার দল নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে এখন তিনি নিঃস্ব। সিদ্ধিরগঞ্জের বাসার পাশে একটা মুদিদোকান নিয়ে বসেছেন। চা-পানও বিক্রি করছেন। খুলনার মোংলায় একসময় দাপুটে নাচের শিল্পী পারুল দল গঠন করে অনেক শিল্পীর রোজগারের ব্যবস্থা করেন। লোকসানের ঘানি টেনে তিনিও যাত্রা ছেড়েছেন। এখন তাঁর সময় যাচ্ছে পারলারের কাজে। কিশোরগঞ্জে যাত্রাদলের নায়িকা হিসেবে রত্নার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কয়েক বছর নিজে দলও করেছেন। লাভের আশায় লোকসান দিয়েছেন প্রচুর। এখন শৌখিন দলে ডাক পড়লে যা আসে, তা-ই দিয়ে চলছে সংসার। মানিকগঞ্জের কৃষ্ণা স্বামীর সহায়তায় দল গঠন করে ঠকেছেন বারবার। নিজে অভিনেত্রী, স্বামী অভিনেতা; তবু লাভের মুখ দেখতে পাননি কৃষ্ণা। এখন যাত্রার পোশাক ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। বরিশালের গৌরী গীতিযাত্রা আর লেভেল যাত্রার শিল্পী। অধিক লাভের আশায় দল গড়েছেন কয়েকবার। কিন্তু আয় দিয়ে ব্যয় শোধ করতে পারেননি। শেষে অভিনয়কে পুঁজি করে কোনো রকমে টিকে আছেন।

ডেমরার আদমজীতে বসবাস সিনেমার নাচিয়ে মেয়ে মৌসুমি পারভিন তারার। সিনেমায় নাচে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল তাঁর। প্রথমে লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে, পরে নিজের নামে লাইসেন্স করে দল গঠন করেন। কিন্তু তিনিও টিকতে পারেননি। বন্ধ করতে বাধ্য হন যাত্রার ব্যবসা। এখন যাত্রায় নেই, সিনেমাও ছুটি দিয়েছে। বেকার জীবন কাটাচ্ছেন বাড়িতে বসে।

খুলনার সুফিয়া বেগম যাত্রাদল গঠন করে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কয়েক বছর সুনামের সঙ্গে দল চালাতে গিয়ে তিনি এখন সর্বস্বান্ত। দলের মালিক ছিলেন বলে কেউ তাঁকে আর যাত্রায় অভিনয়ের জন্য ডাকেন না। মাঝেমধ্যে বায়না হলে তা দিয়েই সংসার চালাতে হচ্ছে।

একই অবস্থা কয়েকজন ঠিকে মালিকের। তাঁরা মৌসুমি দল করবেন না, কিন্তু ঠিকে দল করে বায়না ধরেন। এখন তাঁরাও বেকার। যাত্রা নেই, বায়না নেই। এমন দলের মালিকের মধ্যে নাজুক অবস্থায় আছেন নরসিংদীর সুফিয়া খাতুন, গাজীপুরের হালিমা খাতুন, নেত্রকোনার বিউটি, সিদ্ধিরগঞ্জের মনোয়ারা, বরিশালের রুপালি, খুলনার দেবী ঘোষ, যশোরের গঙ্গারানী প্রমুখ। যাত্রাদলের এসব নারী মালিক না বুঝে কেউই পেশায় নামেননি। সবাই নৃত্য, গীত, অভিনয়ে পারদর্শী। একসময় প্রত্যেকের দলেই ৩০–৩২ জন শিল্পী-কুশীলব ছিলেন। আর আজ সেসব মালিকই সংসার চালাচ্ছেন নানা কাজের মাধ্যমে। মাঝেমধ্যে যাত্রার কথা উঠলেই হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। বোবা কান্না আটকে থাকে বুকের মধ্যে।