সংকটে নৃত্যশিল্পীরা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়

গত ৩১ মার্চ দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন আয়োজিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পীরা। বিদেশে বা দেশে এমন দলীয় নৃত্যের দৃশ্য আবার কবে দেখা যাবে, তা অনিশ্চিত। ছবি: সংগৃহীত

উৎসবের ঘোষণা নেই। সাজানো হয়নি শিল্পকলা একাডেমির কোনো মিলনায়তন। আজকের দিনটি কোনো অনুষ্ঠান, কোনো আড়ম্বর ছাড়াই কাটাবেন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। অথচ আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস।
মহামারির আগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্‌যাপিত হতো। প্রাচীন এই কলাটির চিরায়ত ঐতিহ্য স্মরণ করে দেশের নানা মঞ্চে নৃত্যের বিভিন্ন ভঙ্গি ও আঙ্গিক দিয়ে অনুষ্ঠান সাজিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করতেন শিল্পীরা। আয়োজন করা হতো তিন, এমনকি পাঁচ দিনের জাতীয় উৎসবও। আজ সেসবের কিছুই দেখা যাবে না। নগরের সংস্কৃতি কেন্দ্রের মিলনায়তনগুলোর ভেতরে নূপুরের নিক্বণ শোনা যাবে না।
মহামারিরকালে গভীর সংকটে এই নৃত্যশিল্প। কেননা নৃত্যের আনন্দ বিনিময় হয় দর্শকদের মধ্যে। কিন্তু এই দর্শক আর শিল্পীর সম্মিলনটা এখন কঠিন, অনিরাপদ বটে। অন্যদিকে অনুশীলন, শিক্ষাদানও এখন থমকে আছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ক্লাসরুম বন্ধ। কবে খুলবে, তার ঠিক নেই।

সাজু আহমেদ। ছবি: প্রথম আলো

ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়মিত নাচ শেখাতেন দিল্লি কত্থক কেন্দ্র থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা নৃত্যগুরু সাজু আহমেদ। বর্তমানে সাকল্য ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত শিখছেন। নিরুপায় এই শিল্পী স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই পাঁচজনকে শেখাচ্ছেন বটে, তবে পেশা হিসেবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য সংখ্যাটা একেবারেই নগণ্য।

এমন পরিস্থিতি আরও কয়েকজন নৃত্য শিক্ষকেরও। অবশ্য বেশ কয়েকজন শিল্পী অনলাইনে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রেখেছেন। কয়েকজন সুফলও পেয়েছেন। যেমন পূজা সেনগুপ্ত জানান, প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে অনলাইনে কয়েক ধারার ক্লাস চলছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। পূজা বলেন, ‘অনলাইনের এই যুগে প্রোগ্রাম কিছুটা কম হওয়ায় পেপার ওয়ার্কের সময় বেশি পেয়েছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রতিষ্ঠান তুরঙ্গমীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নাচের নেটওয়ার্ক আরও বেড়েছে।’

পূজা সেনগুপ্ত ও তাঁর নৃত্যদল তুরঙ্গমীর শিল্পীরা। ছবি: খালেদ সরকার

তবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলে জানান সাজু আহমেদ ও আনিসুল ইসলাম হিরু। তাঁরা দুজন জানান, পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে অনলাইনে কার্যক্রম চালানো কঠিন। কয়েক সেকেন্ডের গরমিলে সম্মিলিত তালের ব্যাঘাত ঘটে। তবলাবাদক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একেক জায়গায় থাকার কারণে এই সমস্যা হতেই থাকে, তাল ছুটে যায়। কত্থক ও ভরতনাট্যমের এই দুই শিক্ষক জানান, দীর্ঘদিন করোনা মহামারির সংকট থাকার ফলে তাঁদের দুজনেরই অনেক শিক্ষার্থী চাকরিহারা হয়েছেন। যাঁরা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বা খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন, তাঁদের অনেকেই এখন বেকার। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন।

আনিসুল ইসলাম হিরু ও তাঁর নৃত্যদল

ইমদাদুল মিলন নামের এক শিল্পী নিকেতন এলাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন পাঁচ বছর ধরে। লকডাউনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি চাকরি হারিয়েছেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে প্রায় ২৫ বছরে ধরে শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছিলেন নৃত্যশিল্পী শহীদুল ইসলাম। গত অক্টোবর মাস থেকে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। নিরুপায় হয়ে তিনি কয়েক মাস পর চাকরি ছেড়ে দেন। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি স্কুল ও কলেজে চাকরি করতেন নৃত্য শিক্ষক হিসেবে। সে প্রতিষ্ঠান থেকেও ছাঁটাই করা হয়েছে। বনানীর একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরিরত জাবেদ হোসেন জানান, তাঁর চাকরি আছে, তবে গত বছরের মার্চ থেকে বেতন দেওয়া হচ্ছে না প্রতিষ্ঠান থেকে। চাকরি হারানো বা বেতন না পাওয়া শিল্পীরা বেশির ভাগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির নিয়মিত শিক্ষক। নৃত্যশিল্পী সাজু আহমেদের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের বেসরকারি স্কুলে যাঁরা নৃত্য শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ চাকরি হারিয়েছেন এই করোনারকালে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে জাতীয় নাট্যশালায় নৃত্যাঞ্চল উৎ​সবের উদ্বোধনী​​ দিনের একটি পরিবেশনা l ফাইল ছবি

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে অনেক নৃত্যশিল্পী। বিশেষ করে যাঁদের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সীমিত এবং যাঁদের রোজগার মূলত ছোটখাটো অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা বেশি সংকটে। তা ছাড়া দেশের বাইরের আয়োজনগুলোও এখন হচ্ছে না। নৃত্যশিল্পীদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট তবলাবাদকদেরও একই অবস্থা। নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান বলেন, ‘করোনায় নৃত্যাঙ্গনে আর্থিক সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। যাঁরা পেশাজীবী, তাঁরা আর্থিকভাবে যেমন সংকটে পড়েছেন, তেমনি মানসিকভাবেও। অনেকে পেশাও বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁরা নাচ কিংবা গান ছাড়তে পারবেন না, কারণ এটা আত্মার খোরাক। তাই আয়ের জন্য বিকল্প উপায়ও খুঁজে বের করতে হচ্ছে। এমনও জানি, কেউ রেস্টুরেন্ট করছেন, কেউ করছেন ক্যাটারিং, অনলাইনে অনেকে কিছু করার চেষ্টা করছেন।’
আগামী দিনও যে খুব কঠিন, তা নিয়ে নৃত্যশিল্পীদের কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক না হলে এই শিল্পীদের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। তবুও এই পরিস্থিতিতে নৃত্যশিল্পীরা আশা করছেন, খুব শিগগির দিন ফিরবে, দেশ-বিদেশের মঞ্চে আবারও বেজে উঠবে নূপুরের নিক্বণ। ক্লাসরুমগুলো মুখর হবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে।