সংকটে যাত্রাশিল্প, জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছেন শিল্পীরা

যাত্রাশিল্পীরা অপেক্ষা করছেন, আবার কবে রাতের আঁধার চিরে জ্বালাবেন যাত্রা প্যান্ডেলের ঝলমলে আলো। ফাইল ছবি

ভানুচন্দ্র ভৌমিকের বয়স তখন অনেক কম। অভিনেত্রী মায়ের কোলেই সে সময় শুরু হয় তাঁর মঞ্চজীবন, বাবা বাজাতেন বাঁশি। মা-বাবার যাত্রাদলের সঙ্গে দেশের আনাচকানাচ ঘুরে বেড়াতেন ছোট্ট ভানুচন্দ্র। বড় হয়ে তিনি যাত্রাকেই করেন জীবিকা। এখানেই কেটেছে তাঁর ৪৬টি বছর। তাঁর এত বছরের পেশাগত জীবনে নানা রকম সংকট এসেছিল, ছিল উত্থান–পতন। তাতে হার মানেননি ভানুচন্দ্র। তবে এবার আর পেরে ওঠেননি। করোনা মহামারিতে মাত্র তিনজনের সংসার টানতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। ধারদেনা করে চলছে তাঁর সংসার। যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত যাঁরা, তাঁদের প্রায় শতভাগ শিল্পীর গল্প অনেকটা এ রকমই। করোনা মহামারিতে ভয়াবহ সংকটে আছেন শিল্পীরা।

একটি যাত্রার দৃশ্যে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মিলন কান্তি দে।

সারা বছর যাত্রার আয়োজন হয় না বললেই চলে। যেটুকু হয়, শীতকালে। বিগত শীত থেকে সে আয়োজনও বন্ধ। মাঝখানে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে যাত্রা আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এসব কারণে এখন পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন যাত্রাশিল্পীরা। অর্থাভাবে খেয়ে না খেয়ে, ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। যাত্রাদলের অনেক সদস্য কাজের খোঁজে বহু আগেই গ্রাম ছেড়েছেন।

যাত্রাশিল্পী মোসলেম উদ্দীনের (৫২) বাড়ি মানিকগঞ্জের মহাদেবপুরে। সংসারে সদস্য ছয়জন। স্ত্রী রীনা খাতুনও অভিনয় করেন। তাঁদের দলের নাম রীনা সাজঘর অপেরা। দুই যুগ যাত্রায় অভিনয় করা মোসলেম বলেন, ‘আমাদের খুব করুণ দশা যাচ্ছে। এই কাজের ওপর আমরা শতভাগ নির্ভরশীল।

ফাইল ছবি

প্রায় দেড় বছর কোনো আয় নেই। দিনের পর দিন ঘুমাতে যাওয়ার সময় কেবল চিন্তা, কাল কী খাব? আইডি কার্ড, ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বসে আছি। কার কাছে সাহায্য চাইব, জানি না। এবার কোনো সহায়তা না পেলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’ রীনা জানান, অভিনয় ছাড়া আর কিছু শেখার প্রয়োজন বোধ করেননি কখনো। ভেবেছিলেন, এভাবেই জীবন চলে যাবে। বয়স বেড়ে গেছে বলে এখন আর কোনো কাজও পাচ্ছেন না। একবার পোশাক কারখানায় কাজের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের এক পোশাক কারখানায় পরিচিত লোকের মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলাম। সেখানে নাকি বয়স্ক মানুষ নেয় না। যাত্রার সঙ্গে আমরাও অচল হয়ে গেছি।’

গ্রামবাংলা নাট্য সংস্থার স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন জানান, তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন ৩২ জন। সবাই খবর নেন আবার কবে কাজ শুরু হবে। গত বছর তাঁর দলের সাত সদস্য সহায়তা পেয়েছিলেন। তারপর গত ৯ মাস আর কেউ কিছুই পাননি। তিনি বলেন, ‘যাত্রার ওপর এখন আর আমরা ভরসা করতে পারছি না। এভাবে করোনা চললে যাত্রা টেকানো যাবে না। আমাদের সবাইকে বাধ্য হয়ে পেশা বদলাতে হবে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত যাঁরা, সরকার যদি তাঁদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা উপকৃত হতাম।’

মানিকগঞ্জের উথুলিয়া, ব্যাপারীপাড়া, সিঙ্গাইর, শিবালয়সহ বেশ কিছু এলাকায় বাস করেন যাত্রাশিল্পীরা। সংখ্যায় দুই শতাধিক। যাত্রাশিল্পী পরিচয়ে তাঁরা গর্বিত। হওয়ারই কথা! রাতভর মানুষকে তাঁরা আবিষ্ট করে রাখতেন ঐতিহাসিক গল্প আর লোককাহিনিভিত্তিক পালায়। এসবের মধ্যে খুঁজে নিতেন নিজেদের আনন্দ। সেই আনন্দ যেন মরে গেছে। তাঁরাই এখন খুঁজছেন খেতের কাজ। কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা, কেউ ঋণ নিয়ে বাড়ির সামনে খুলেছেন মুদিদোকান।

সবাই অপেক্ষা করছেন, আবার কবে যাত্রা শুরু হবে। কবে তাঁরা মহড়ায় ব্যস্ত হবেন। রাতের আঁধার চিরে জ্বালাবেন যাত্রা প্যান্ডেলের ঝলমলে আলো, যে আলো তাঁদের বাঁচাবে। একটি অনলাইন আড্ডার অভিজ্ঞতা জানিয়ে শিল্পী লায়লা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েকজন যাত্রাশিল্পী জানাল, তাঁদের কেউ এখন রিকশা চালান, কেউ ফেরি করে তরকারি বিক্রি করেন। এই পেশা এখন বড় সংকটে।

যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মিলন কান্তি দে জানান, করোনার আগে থেকেই যাত্রাশিল্প নাজুক অবস্থায় ছিল। এখন তাঁদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দরকার। সেটা শুধু মুখে বললে হবে না, শিল্পকলা একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু প্রণোদনা গত বছর যাত্রাশিল্পীরা পেয়েছিলেন বটে, তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সেই প্রণোদনা ৮ হাজার শিল্পীর মধ্যে ৫০০ জনও ঠিকমতো পাননি। বণ্টনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। তিনি বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে যাত্রাশিল্পীদের জন্য নিয়ম করে একটি কোটার আওতায় বরাদ্দ দিতে হবে। সেটা তালিকা ধরে জেলা প্রশাসক অফিসে পাঠিয়ে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হতে পারে। তবেই যাত্রাশিল্পীরা বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবেন।