সংকটেই নাটক টিকে থাকে
নন্দিত ফরাসি অভিনেতা ও নাট্যজন জাঁ–পল সারমাদিরা ইউরোপে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে সক্রিয় চার দশকের বেশি সময় ধরে। মলিয়েঁর, চেখভ, শেক্সপিয়ার ও দস্তয়েভস্কির ৪০টির বেশি নাটকে এবং ডজনখানেক চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজে অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি রুশ কথাসাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছেন ‘ড্রিম অব আ রিডিকুলাস ম্যান(হাস্যকর মানুষের স্বপ্ন)’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত তাঁর একক অভিনয়ের একটি নাটক নিয়ে। ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ কার্যালয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হন তিনি। এক ঘণ্টার আলাপে উঠে আসে সাম্প্রতিক সময়ের নাট্যচর্চা, সাহিত্য, রাজনীতি ও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিষয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ মুনির।
করোনার প্যানডেমিক চলছে। এই সময় আপনি এই দেশে নাটক নিয়ে এসেছেন। এই বাস্তবতায় নাটক করতে কেমন লাগল?
সারমাদিরা: এককথায় অসাধারণ। ঢাকার শিল্পকলা দর্শকে ঠাসা ছিল। আর চট্টগ্রামে এক আসন বাদ দিয়ে দর্শক বসেছেন। তবে ফাঁকা থাকেনি। ফ্রান্সেও এমনটা আশা করা যায় না। আমি অবিভূত।
লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব আর নানা নিয়মের বেড়াজাল নাটকের ক্ষতি করেছে কি? থিয়েটার কি আগের জায়গায় আছে?
সারমাদিরা: দেখুন, আমি বছরখানেক আগে পদুচেরিতে ফ্রাংকোফোনে নামের একটা উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছি। ওই উৎসবে আমার নাটক করার কথা ছিল। কিন্তু প্যানডেমিকের কারণে অনেকে আসতে পারেনি। শেষে সে দেশের সরকার লকডাউন দিয়ে দেওয়ায় উৎসবটাই বাতিল হয়ে যায়। অতিথিদের সবাই ফিরে গেলেও আমি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পদুচেরির কাছেই অরভিল নামের একটা ছোট্ট শহরে আমি আর আমার স্ত্রী লকডাউনের সময়টায় ছিলাম। সেখানেই পরিচয় এক ফরাসি ভদ্রলোকের সঙ্গে। তখন মাথায় ভাবনা এল আমরা তিনজন তো আছি। তিনজন মিলে একটা নাটক দাঁড় করাই না কেন। সেই ফরাসি ভদ্রলোক ঋষি অরবিন্দের ভক্ত, তিনি তাঁর দর্শন নিয়ে কাজ করতে চাইলেন। শেষে আমরা ঋষি অরবিন্দের দর্শন নিয়ে একটা নাটক দাঁড় করালাম। অরভিলের নানা জায়গায় সে নাটক প্রদর্শিত হলো। তো লকডাউন স্বাভাবিকতা নষ্ট করেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ সেখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজেছে। এতে নতুন কিছুর জন্ম হয়েছে। যেখানেই একটা কিছু শেষ হয়, সেখানেই নতুন একটা কিছুর জন্ম হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
করোনার আগে থেকেই বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে যাচ্ছিল। এখন সবাই যেভাবে ঘরে ঢুকেছে, আর সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে, তাতে থিয়েটার করতে গিয়ে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হন কি না?
সারমাদিরা: জঁ ভিলা নামের বিখ্যাত এক ফরাসি নাট্যকার বলেছিলেন, নাটক খুব সংকটে আছে, এতেই বোঝা যায় নাটক বেঁচে আছে। আসলে সংকটেই নাটক টিকে থাকে। অথবা সংকট আছে বলেই নাটক আছে, এটাও বলা যায়। নাটকে সেট, গল্প, মঞ্চ কিছুরই দরকার পড়ে না। টাকারও না। কেবল দুটি জিনিস অপরিহার্য। তা হলো অভিনয়শিল্পী আর দর্শক। একজন অভিনয়শিল্পী আরেকজন দর্শক হলেই নাটক সম্ভব।
দুই শ বছর পরও দস্তয়েভস্কি প্রাসঙ্গিক, আপনি তাঁর ‘ড্রিম অব আর রিডিকুলাস ম্যান’ গল্পটি নিয়ে নাটক করেছেন। এই গল্প আমি একাধিকবার পড়েছি। প্রিয় একটি গল্প। এতে দেখা যায়, উত্তম পুরুষে বয়ানকারী আত্মহত্যা করতে যাওয় (রিডিকুলাস ম্যান) মানুষটি স্বপ্নে একটি ইউটোপিয়ার জগতে চলে গেলেন। সেখানে সব মানুষ সুখী। যূথবদ্ধ জীবন তাদের। আগন্তুক পৃথিবীর মানুষ তাদের মিথ্যা বলতে শিখিয়েছিলেন নিজেরই অজান্তে। এরপরই সেখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়, সেখান থেকে লোভ, অহংকার, রক্তপাত আর ধ্বংস। এই লক্ষ্য কি সমকালের পৃথিবীর সংকটকে দেখিয়ে দেওয়া?
সারমাদিরা: একদম ঠিক ধরেছেন। দেখুন, আমরা প্রকৃতিকে নিজের মতো রূপ দিয়েছি, নষ্ট করেছি, কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবছি। এই গল্প যেন মানুষকে লাগম ধরতে বলে। এ কারণেই এই গল্পটা আমার অনেক সমকালীন মনে হয়। মনে হয় এ কালের কথাই বলা হচ্ছে। এই নাটকে আমি একটি সংলাপ ব্যবহার করেছি। তা হলো, ‘আমি একটি ভাইরাস।’ লোকে তো ভাইরাস বলতে করোনা ভেবেছে। আমার দেশের অনেক সমালোচক বলেছেন, আমি টেক্সট পাল্টেছি। কিন্তু না, মানুষের অনিষ্টকারী স্বভাবই তো ভাইরাস। আমি লাগসইভাবেই তা ব্যবহার করেছি।
একই জিনিস আমরা দেখেছি, জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরাসাওয়ার ‘ড্রিম’ নামের চলচ্চিত্রে। তিনিও দস্তয়েভস্কির এই গল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সারমাদিরা: আশ্চর্য, এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে। আমি ‘ড্রিম’ দেখে সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু আগে কেউ কখনো বলেনি। আপনিই আজ প্রথম বললেন। কেবল কুরাসাওয়া নন, অনেকেই দস্তয়েভস্কির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন বড় দার্শনিক ছিলেন।
চলচ্চিত্রে আপনি সমানতালে অভিনয় করেছেন। মঞ্চ না চলচ্চিত্র—কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?
সারমাদিরা: এখন আমি পুরোপুরি নাটকের লোক। নাটকের মাধ্যমে আমি অনেক মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে আসতে পারছি। অনেক দেশে নাটক নিয়ে যেতে পারছি। আর আমি যা চাই, সেটা মঞ্চেই করা সম্ভব। চলচ্চিত্রে লগ্নি আছে, সেই লগ্নি উঠিয়ে আনতে আপনাকে পরিচালকের কথা শুনতে হবে। নিজের স্বাধীনতা থাকবে না। এখানে আমি অনেক স্বাধীন। নিজের দর্শন নিয়ে শতভাগ কাজ করতে পারি।
ওটিটি প্ল্যাটফরমের রমরমা অবস্থা। মানুষ নেটফ্লিক্স আর আমাজন প্রাইমে মজেছে।
সারমাদিরা: এটি বরং নাটকের জন্য ভালো হয়েছে। ৫০, ৬০–এর দশকে একজন চলচ্চিত্র তারকার ফটোগ্রাফ দেখলেও মানুষ থমকে যেত, উত্তেজিত হতো। এখন হলিউডের সেরা অভিনেতাকেও সে প্রতিনিয়ত মুঠোফোনে দেখছে। কিন্তু সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিজ্ঞতা মানুষকে একমাত্র থিয়েটারই দিচ্ছে। তাই দর্শকেরা আবারও থিয়েটারে ফিরছেন। আর দেখুন, অনেকে বলছিল, বাংলাদেশে তুমি দর্শক পাবে না। কারণ, নাটক ফরাসি ভাষায়, দর্শকেরা বাঙালি। সাবটাইটেল থাকলেও তা আবার ইংরেজি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এখানকার দর্শকেরা দারুণভাবে সাড়া দিয়েছেন।
আমাদের দেশের নাটক নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে?
সারমাদিরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ থেকে শুরু করে নানা নাটকের দলের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে এখনো নাটক দেখার সুযোগ হয়নি। আমি দক্ষিণ ভারতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সেখানকার প্রকৃতি অসাধারণ, কিন্তু এ দেশে আমি মুগ্ধ হয়েছি এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে। আমার মনে হয়েছে, আমাদের দুই দেশের নাটক নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
মূলধারার অনেক চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজে এখন মাত্রাতিরিক্ত ভায়োলেন্স দেখা যায়। স্কুইড গেমসের কথাই ধরুন। দর্শক কি ভায়োলেন্সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে?
সারমাদিরা: আসলে ভায়োলেন্স নয়, এসব সিরিজে আসক্তির একটা বিষয় থাকে। আমি নিজেও দেখেছি এটা। একটা পর্ব দেখে আপনি আরেক পর্ব দেখার অপেক্ষায় থাকবেন। দেখতে বাধ্য হবেন। দর্শকের কোনো দোষ নেই এখানে।
শেষ প্রশ্ন করি, নাটক কি সমাজ বদলাতে পারে?
সারমাদিরা: রুমি বলেছেন, আমি তোমাকে বদলাতে পারব না, যা পারি, তা হলো নিজেকে বদলাতে। নাটকের মাধ্যমে আমি সমাজবদলের স্বপ্ন দেখি না। তবে নাটক আমাকে বদলে দিয়েছে এ কথা সত্য।