সৃষ্টিশীলতায় বিভোর এক মানুষ ছিলেন আলী যাকের

আলী যাকেরের প্রিয় গান ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’ গেয়ে শোনান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।সাবিনা ইয়াসমিন

‘সবকিছু ভুলতে পারলেও ভুলতে পারি না এই মঞ্চ। যতবার নাটক নিয়ে মঞ্চে উঠি, প্রতিবারই যেন আমার পুনর্জন্ম হয়।’ সময়টা ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর। গ্যালিলিও হয়ে শেষবারের মতো মঞ্চে উঠেছেন আলী যাকের। নাটক শেষে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। এভাবেই মঞ্চের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন এই বরেণ্য অভিনয়শিল্পী।
শনিবার ছিল এই কিংবদন্তি অভিনেতার ৭৭তম জন্মদিন। এদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আয়োজনে ‘স্মৃতিতে স্মরণে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই শিল্পীকে জানানো হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। সহকর্মীদের মূল্যায়নে উঠে এল তাঁর অভিনয়জীবনের নানা কীর্তি।
‘গুরু বন্দনা’ নাচ দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। চারটি পর্বে বিভক্ত ছিল আয়োজন। যেখানে নাট্যজন আলী যাকেরের স্মৃতিচারণা করেন তাঁর সহশিল্পী ও শুভার্থীরা। সেই সঙ্গে আলী যাকেরের পছন্দের গান, কবিতা পরিবেশন করেন শিল্পীরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর। প্রথম পর্বের স্মৃতিচারণায় অংশ নেন নাট্যজন আবুল হায়াত, ফেরদৌসী মজুমদার ও আবদুস সেলিম।

স্মৃতিচারণ করছেন সারা যাকের। ছবি: প্রথম আলো
সাবিনা ইয়াসমিন

সূচনা বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছেন তিনি। বাঙালিত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। আবুল হায়াত বলেন, তাঁকে নিয়ে মঞ্চে কথা বলতে হবে, ভাবিনি। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর জন্মদিন সবাই মিলে উদ্‌যাপন করতাম। কিন্তু জন্মদিন উদ্‌যাপনের পরিবর্তে আয়োজনটি স্মৃতিচারণায় পরিণত হলো। এই কীর্তিমান মানুষটি সব সময় সৃষ্টির চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। আজ তাঁর সামনে যদি তাঁর গুণের কথা বলতে পারতাম, তাহলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এটা মেনে নিয়েই বলতে চাই আলী যাকের এক প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষ। গুণী ও আলোকিত এই মানুষটি অভিনয়ে নিষ্ঠাবান ছিলেন।

বাবার স্মৃতিচারণ করছেন ইরেশ যাকের। ছবি: প্রথম আলো
সাবিনা ইয়াসমিন

পাশাপাশি তাঁর মতো শিশুসুলভ সহজ মানুষ আমি দেখিনি। বলছিলেন সহ-অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। নাট্যকার আবদুস সেলিমের মতে, আলী যাকের শুধু সেলিব্রিটি ছিলেন না, ছিলেন রুচিমান, পরিশীলিত একজন মানুষ।

প্রথম পর্বের স্মৃতিচারণায় অংশ নেন আবদুস সেলিম, নাট্যজন আবুল হায়াত, ফেরদৌসী মজুমদার ও আসাদুজ্জামান নূর।

অনুষ্ঠানে আলী যাকেরের প্রিয় গান ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’ গেয়ে শোনান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং প্রিয় কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আবৃত্তি করেন আহকামউল্লাহ। দ্বিতীয় পর্বের স্মৃতিচারণায় অংশ নেন নাট্যজন আতাউর রহমান, লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তুমি নির্মল করো’ পরিবেশন করেন প্রিয়াঙ্কা গোপ ও জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন শিমুল মুস্তাফা।

তৃতীয় পর্বে স্মৃতিচারণা করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ ও নাট্যকার মাসুম রেজা। এ সময় বাবা আলী যাকেরের স্মৃতিচারণা করেন ছেলে ইরেশ যাকের। এ পর্ব শেষে মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ গেয়ে শোনান জয়িতা এবং আলী যাকেরের আত্মজীবনী সেই অরুণোদয়ের থেকে পাঠ করেন ত্রপা মজুমদার।

‘গুরু বন্দনা’ নাচ দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান
সাবিনা ইয়াসমিন

চতুর্থ ও শেষ পর্বের স্মৃতিচারণায় অংশ নেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও তারিক আনাম খান। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে স্বামীর স্মৃতিচারণা করেন আলী যাকের-পত্নী সারা যাকের। সবশেষে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন বাপ্পা মজুমদার।