‘৪২ বছর পর যাত্রাপালা দেখে মুগ্ধ হলাম’

আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘মেরাজ ফকিরের মা’ অবলম্বনে নির্মিত সামাজিক যাত্রাপালা গত শনিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল মাঠে করা মঞ্চে মঞ্চায়ন করা হয়। পালা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলে উঠলেন, ‘৪২ বছর পর যাত্রাপালা দেখে মুগ্ধ হলাম। পালাটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়াল। মুক্তবুদ্ধি চর্চার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এই যাত্রার শুভযাত্রা হোক।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজুর নির্দেশনায় ফোকলোর বিভাগের ‘ফোকলোর রেপার্টরি যাত্রাদল’ রাজশাহী জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় যাত্রাপালাটি পরিবেশন করে। ‘যাত্রাশিল্পের নবযাত্রা’ স্লোগানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘দেশব্যাপী ১০০ নতুন যাত্রাপালা মঞ্চায়ন কর্মসূচি’র আওতায় বাংলাদেশ যাত্রা উৎসব-২০২২ শুরু করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ উৎসব শনিবার শুরু হয়।

সেদিন রাত আটটায় যাত্রা শুরুর সময় দেওয়া হয়। তার আগেই ভেতরে ঢুকতে বাইরে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র মামুনুজ্জামান জানালেন, ‘এই প্রথম যাত্রাপালা দেখলাম। যাত্রাপালা কেমন হয়, তা শুধু বইপত্র আর নাটক-সিনেমায় দেখেছি। বাস্তবে কখনো যাত্রাপালা দেখার সুযোগ হয়নি। আজই প্রথম দেখলাম। বেশ ভালো লেগেছে।’ চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অভয় চরণ সূত্রধরের ভাষায়, ‘সমাজের সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য আমরা আমাদের মা, মাটি ও ধর্মকে চিনতে ভুল করি। ধর্মের দোহাই দিয়ে ভেদাভেদ তৈরি করি কিন্তু আমাদের মা, মাটি ও মানুষ যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তা এই যাত্রাপালার মাধ্যমে অনুধাবন করতে পারলাম।’ ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের এ যাত্রাপালায় পরিবেশনের সময় দর্শকেরা মাটিতে ও চেয়ারে বসে থেকেই বিশেষ দৃশ্যগুলোতে সাড়া দিয়েছেন। কখনো করতালি, কখনো দর্শকসারি থেকেই দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেছেন কেউ।

পালার কাহিনিটি এ রকম—বাবা ধীরেনের যাত্রাদলে অভিনয় করতেন আলো রানী। দলে ছিলেন মোজাফফর মণ্ডল। মঞ্চ ছেড়ে বাস্তব জীবনেও তাদের মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়। জানতে পেরে ধীরেন তার ‘ধীরেন অপেরা’ যাত্রাদল ভেঙে দেন। কিন্তু আলো-মোজাফফরের মন তিনি ভাঙতে পারেননি। তারা পালিয়ে ঘর বাঁধেন। আলো রানী পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘আলো বিবি’ নামে। তার তিন ছেলের মধ্যে একজন মেরাজ ফকির। তিনি খানকা চালান। ফতোয়া দেন। ছোট ছেলে পিয়ারের মন আবার যাত্রাদলে অভিনয়ে। আরেক ছেলে সিরাজ বউ নিয়ে থাকেন শহরে। আর গ্রামে মেরাজ ফকিরের সঙ্গে গ্যাদা ফকিরের দ্বন্দ্ব।

৩৯ বছর পর জীবনসায়াহ্নে এসে ধীরেন তার মেয়ে আলো রানীর খোঁজ পান। তিনি মেয়ের গ্রামে আসেন। মেয়ের মুখ দেখার আগেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আলো রানী বাবার মরা মুখ দেখে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যান। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেন।

এ অবস্থায় গ্যাদা ফকির তার প্রতিদ্বন্দ্বী মেরাজ ফকিরকে ঘায়েল করার সুযোগ নেন। তিনি প্রচার করতে থাকেন, মেরাজ ফকিরের মা আসলে একজন হিন্দু নারী। মেরাজ ফকিরকে অন্য ধর্মের বলে প্রচার করেন। মেরাজও হয়ে ওঠেন ক্ষুব্ধ। এই পরিচয় মুছে ফেলার জন্য তিনি মাকেই খুন করার জন্য তরবারি তুলে ধরেন। আর তখনই তার বাবা মোজাফফর এবং তার দুই ভাই সিরাজ ও পিয়ার মেরাজ ফকিরকে বুঝিয়ে দেন, মায়ের অবস্থান কোথায় এবং কত গুরুত্বপূর্ণ। এতে মেরাজ ফকিরের ভুল ভেঙে যায়।