অভিনয় করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাই

দিলারা জামান। ছবি: সুমন ইউসুফ
১৯৬৫ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের রচনায় ও মোহাম্মদ জাকারিয়ার পরিচালনায় ‘ত্রিধারা’ দিয়ে শুরু হয় তাঁর অভিনয়জীবন। আজও অভিনয়ের সঙ্গেই আছেন। এই বয়সেও শুটিংয়ের জন্য ছুটতে হয় দেশ-বিদেশে। ৭৮ শেষ করে ৭৯তে পা দিলেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান

প্রশ্ন :

জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ধন্যবাদ। জন্মদিন তো উদ্‌যাপন করি না। দুই মেয়ে দেশে থাকলে উৎসাহ নিয়ে করে, আবার আমি তাঁদের কাছে থাকলেও করে। অভিনয় অঙ্গনে আমার সহকর্মীরাও উৎসাহ দেখায়। চ্যানেল আইয়ের সরাসরি অনুষ্ঠান তারকাকথনে—প্রায়ই আসা হয়। মেঘে মেঘে তো বেলা কম হলো না। ৭৯ বছরে পা দিলাম। এত দিন সুন্দরভাবে বাঁচতে পেরেছি, এখনো সুস্থ আছি—এটাই কম কি। আলহামদুলিল্লাহ। তবে আফসোস, এখনো তো কিছুই তো করতে পারিনি। মানুষের মনে জায়গা করে নিতে বা মানুষ যাতে সব সময় মনে রাখে, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। জানি না, কতটুকু মানুষ মনে রাখবে।

প্রশ্ন :

কী করতে চেয়েছিলেন, যা নিয়ে জন্মদিনেও এত আফসোস?

এমন একটা প্রতিষ্ঠান করব, যার মাধ্যমে অনেক মানুষের উপকার হবে, আশ্রয় হবে, ঠাঁই হবে। যাদের কেউ নেই, বুড়োকালে যারা একাকী থাকেন—ও রকম মানুষের জন্য কিছু করা। অবশ্য আমার একার পক্ষে তো এটা এখন আর সম্ভব না।

জমকালো সাজে দিলারা জামান
ছবি: আবির হোসেন নোমান, আইস টুডে

প্রশ্ন :

আপনি কি বৃদ্ধাশ্রমের কথা বলছেন?

হ্যাঁ। এটা করতে পারাটা আমার একটা স্বপ্নের মতো।

প্রশ্ন :

এই স্বপ্ন কবে দেখছেন?

৩০ বছর আগে গাজীপুরের একটি ওল্ডহোমে শুটিং করতে গিয়েছিলাম। নাটকের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। আমার সহশিল্পী আনোয়ার হোসেন ভাই। ওই নাটকেরই শুটিং করতে গিয়ে বুড়ো মানুষের অসহায়ত্ব দেখি। এমনিতেও চারপাশে বুড়ো মানুষের কষ্ট দেখি। শেষ বয়সে এসে তো তাঁরা শিশুর মতো হয়ে যান, তখন তাঁদের আর সেভাবে দেখার মতো কেউ থাকে না। অথচ এই সময়টায় তাঁরা থাকেন খুব অসহায়, কিছু বলতেও পারেন না। মা-বাবারা তখন বিষয়গুলো নিজেই উপলব্ধি করতে পারেন। বৃদ্ধ মানুষের কষ্টটা কেউ বুঝতে পারে না, চায় না। আপন যে সন্তান সেও বুঝতে পারে না।

বিয়ে উৎসবের মঞ্চে অভিনেত্রী দিলারা জামান

প্রশ্ন :

আপনার বৃদ্ধাশ্রমের স্বপ্নটা এখনো আছে?

হ্যাঁ, থাকবে না কেন। আমার ছোট মেয়ে তো বলে, দেখি আমার মায়ের অপূর্ণ স্বপ্নপূরণে কিছু করতে পারি কি না।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতার সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা কী যায়?

সময়ের সঙ্গে মন–মানসিকতাও বদলাতে হবে। আগে যেমন একান্নবর্তী পরিবার ছিল, এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। দেখা গেল আসার সময় বাইরে থেকে রাতের খাবারও নিয়ে আসেন। আবার তাঁরা তাঁদের নিজেদের সন্তানকে চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে রেখে যান। একজন বয়স্ক মানুষ বাসায় থাকলে তাঁর খাওয়াদাওয়া, দেখাশোনা, নানা রকম ব্যাপার আছে। একপাক্ষিক চিন্তা করলে তো হবে না। বাস্তবতার কারণেই এটাকে মানতে হবে। গ্রামও তো এখন আর গ্রাম নেই, আধুনিক জীবনের যা যা কিছু থাকার সব এখন গ্রামেও আছে।
যখন যে অবস্থা তৈরি হয়, ওটার সঙ্গে মানিয়ে আমাদের চলতে হবে। সময়টাকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। আমি এ–ও জানি, সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন না। আমি দেশের বাইরেও থেকেছি, মেয়েদের কাছে—ওখানকার জীবনযাপনের ধরন আমাদের এখানেও চলে এসেছে। একসময় আমরা বলতাম, ধনীরাই শুধু এসব করে কিন্তু এখন তো দেখছি নিম্নবিত্তের মধ্যেও এই প্রবণতা চলে এসেছে। আমার বাসায় কাজের মেয়েটা, সে তার শাশুড়িকে সঙ্গে রাখতে চায় না। বোঝা মনে করে। ওর কাছে শুনেছি, তার শাশুড়ি এক মাস তার কাছে থাকে, আরেক মাস আরেকজনের কাছে থাকে।

প্রশ্ন :

এতে করে কী মানুষে মানুষে মায়া-মমতাও কমে যাবে কি?

সবই চলে যাবে। মায়া-মমতা মোটেও থাকবে না। মায়া-মমতা তো চলেও যাচ্ছে এবং যেতে বাধ্য।

প্রশ্ন :

তাহলে তো সামনে আমাদের আরও কঠিন সময়ের অপেক্ষা করতে হবে?

অপেক্ষা করতে হবে কি, কঠিন সময়ে তো আমরা আছি-ই। করোনাকালে তো আমরা দেখেছি, মানুষ কতটা অমানবিক হতে পারে। করোনা আক্রান্ত মাকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গেছে সন্তান, ঠিকানা জানে না কেউ।

প্রশ্ন :

উল্টো চিত্রও তো দেখা গেছে।

তা দেখা গেছে। কিন্তু তুলনামূলক অনেক কম।

প্রশ্ন :

তাহলে এভাবেই কি চলবে?

আমার তো মনে হয় এভাবেই চলবে। মায়া-মমতা ফিরে আসার পথ তো দেখি না। যদিও আমি মনে করি, মানুষে মানুষে মায়া-মমতা, ভালোবাসা ফিরে আসাটা জরুরি। তবে আমি মনে করলে তো চলবে না। বাস্তবতা তো অন্য কথা বলে।

শুভেচ্ছা জানাতে এসে সহ-অভিনেত্রী দিলারা জামানের সঙ্গে এক মুহূর্তের নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: হাসান রাজা

প্রশ্ন :

বাস্তবতা যাই বলুক। আপনার মন কী বলে?

আমি তো পুরোনো ধ্যানধারণা নিয়েই থাকব। এখনো আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারি না। ১৯৯৬ সালে যে মোবাইল কিনেছি, বাটন টিপে আজও সেটাই ব্যবহার করছি। আমার কাছে এটাই স্বস্তির মনে হয়। এখনো সকালবেলা দরজা খুলে দেখি, পত্রিকাটা আসছে কি না। চা-নাশতা বানিয়ে খেতে খেতে হাতে নিয়ে পত্রিকা পড়ি। অন্যরা সবাই যেখানে স্মার্টফোনে সব খবর জেনে নিচ্ছে, আমার তা হয় না। ৬০-৭০ বছরের যাঁরা, তাঁরা এই জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আমাকে অনেক পরিচালক বলেন, স্ক্রিপ্টটা কি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাব বা মেইল করব? আমি বলি, না, আমাকে একটু কষ্ট করে বাসায় পাঠিয়ে দেন। আমি হাতে নিয়েই পড়ব। আমার বিছানায় বালিশের পাশে স্ক্রিপ্ট থাকবে, পড়ব, মুখস্থ করব—এতেই আমি অভ্যস্ত। ৭৯ বছরে পা দিলাম, জানি না কত দিন সক্ষম থাকব, তবে এভাবেই করে যাব।

প্রশ্ন :

অভিনয় কি তাহলে আমৃত্যু করে যাবেন?

আমার তো তেমনই চিন্তা। অভিনয় করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাই। যে যাই বলুক না কেন, যতই ব্যাকডেটেড বলুক না কেন, আমি আমার অভ্যাস থেকে বের হতে পারব না। যার জন্য আমেরিকা ও কানাডায় থাকা মেয়েরা আমাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখার পরও নিজের দেশ, মাটি, অভিনয়ের টানে ফিরে এসেছি।

প্রশ্ন :

৫৬ বছরের অভিনয়জীবনে স্বপ্নের চরিত্রের দেখা পেয়েছেন?

স্বপ্নের চরিত্র এখনো করতেই পারিনি মনে হয়। এখনো স্বপ্ন দেখি, এমন একটা চরিত্রে অভিনয় যেন করতে পারি, যা সব মানুষের মনে দাগ কেটে যায়। পরিচালকেরাও হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবেননি।

প্রশ্ন :

সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের প্রতি আগ্রহ আছে?

আমি মনে করলে কি আর হবে? মনে তো হয় অনেক কিছু, কিন্তু বলেও লাভ কী?

প্রশ্ন :

আজকের অভিনয়শিল্পীদের কেমন দেখছেন?

ওরা এসব নিয়ে ভাবে না। ওদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। ওরা এখন অন্য জগতের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। আধুনিক ও গতিময় জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যার জন্য স্ক্রিপ্ট পড়ে, চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময়ই যেন নেই। মহড়া তো পরের কথা। এখন তো অনেকে দেখি গল্প বলছে একরকম, গল্প না পড়ায় চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয় এমন কস্টিউম নিয়েই শুটিংয়ে হাজির হয়!

‘গল্পগুলো আমাদের’ নাটকে সৈয়দ হাসান ইমাম ও দিলারা জামান

প্রশ্ন :

এতে করে তো মানুষ অভিনয়শিল্পীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

নেবে কি! নিয়েছে তো। আমাদের নাটক এখন আগের মতো কেউ দেখতে চায় না। অবাস্তব ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প, জীবন ঘনিষ্ঠ না—তাই দর্শকেরও ভালো লাগে না। সিরিয়াস হতে হবে বললেও তো হবে না।

প্রশ্ন :

কী করা উচিত?

জানি না, এসবের জন্য সবাই দায়ী। সবারই দায়বদ্ধতা আছে। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। যিনি অভিনয় করেন তিনিও যেমন বলবেন, যিনি ডিরেকশন দেন তিনি তো আরও আগে বলবেন।