খুব অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি

অভিনেতা সোহেল রানা। ছবি: সংগৃহীত
অভিনেতা সোহেল রানা। ছবি: সংগৃহীত

 ৪৬ বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘মাসুদ রানা’ সিনেমার ‘মনেরও রঙে রাঙাব’ গানটি আজও শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও গানটি কাভার করেন। নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক সোহেল রানা প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘মাসুদ রানা’য় এই গানের চিত্রায়ণে অংশ নেন কবরী। বরেণ্য এই চিত্রনায়ক প্রযোজিত ওই ছবিটি ছাড়াও তাঁর বেশির ভাগ ছবিরই সংগীত পরিচালনা করেছেন সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান। গেল শনিবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা এই সংগীতজ্ঞের সঙ্গে কাজ করার সময়ের অভিজ্ঞতা ও তাঁকে নিয়ে রোববার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন সোহেল রানা

আপনার প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা মাসুদ রানার সংগীত পরিচালনা করেছেন আজাদ রহমান। ৪৬ বছর আগে তৈরি করা মনেরও রঙে রাঙাব গানটি এখনো মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। আজাদ রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত কীভাবে?

আজাদ রহমানকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। তখন তো বাংলাদেশ বেতারে গান শুনতাম। আজাদের সুরে বেতারে নিয়মিত গান বাজত। বেতারে শুনতে শুনতে অনেকগুলো গানের সুর ভালো লাগত। তাঁর গানের ভিন্ন একটা স্টাইল ছিল, মেলোডিও ছিল অসাধারণ। গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যেত। বেতারে গান শুনেই তাঁর গানের প্রেমে পড়ে যাই। তারপর নিজের প্রচেষ্টায় খোঁজ করে বের করি। এরপর আমাদের কাজ নিয়ে আলাপ। ১৯৭৩ সালে ‘মাসুদ রানা’ ছবির কাজ শুরু করি, মুক্তি পায় পায় পরের বছর।

আজাদ রহমানের সংগীত জীবনের সেরা দশটি গান যদি বাঁছাই করা হয়, তাহলে আপনার ছবির জন্য তৈরি তিনটি গান থাকবেই।

এটা কিন্তু সবাই বলে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সেরা গানের মধ্যে মনেরও রঙে রাঙাব, ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না, ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় এই তিনটি গান রাখতে হবেই। চার দশক আগে আজাদ রহমানের সৃষ্টি আজও আধুনিক। আগামী চার দশকেও এসব গান তার আবেদন হারাবে না। এখনো টেলিভিশন কিংবা রেডিওতে এই গানগুলো শুনতে পাই।

ছবির গান তৈরির সময়কার কোনো কথা কি মনে পড়ছে?

ছবির গান করতে আমি সময় নিতাম। খুব খুঁতখুঁতে ছিলাম বলতে পারেন। আজাদ রহমানও সময় নিয়ে কাজ করতেন। একটা সময় তিনি চাকরি শুরু করলেন, আর কাজ করতে পারলাম না। পাশাপাশি রেডিওতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তত দিনে আমার ‘মাসুদ রানা’, ‘এপার ওপার’, ‘দস্যু বনহুর’ ছবিতে তাঁর সংগীত পরিচালনায় তৈরি গানগুলো সুপারহিট। আজাদ বলত, এখন তো সময় বের করা খুব সমস্যা, চাকরির পাশাপাশি রেডিওতে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংগীত পরিচালক বদল করতে হলো। আমি কাজ শুরু করলাম আলম খানের সঙ্গে। আমার কপালও ভালো বলা যেতে পারে। আমার আর আজাদের কম্বিনেশনটা যেমন হিট ছিল, তেমনি আলম খানের সঙ্গে দারুণ কেমেস্ট্রি তৈরি হলো। প্রথম গান তুমি যেখানে আমি সেখানে সুপারহিট।

 ওনার সঙ্গে আপনার শেষ কাজ কোনটি ছিল?

  এটা মনে করা মুশকিল। খুব সম্ভবত ‘গুনাহগার’ ছিল।

 চলচ্চিত্রের গানে পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে সংগীত পরিচালকদের কাজের স্বাধীনতা নিয়ে মতবিরোধ শোনা যায়। আপনাদের সম্পর্কটা কেমন ছিল?

 সংগীত পরিচালকের সঙ্গে ছবির পরিচালকের একটা ভালো সম্পর্ক থাকতেই হয়। তা না হলে ভালো গান তৈরি করা সম্ভব না। আমার সৌভাগ্য, আমার সঙ্গে যে দুজন সংগীত পরিচালক কাজ করেছেন, তাঁরা যেমন ভালো গান তৈরির জন্য খাটতেন, আমি খুব খাটতাম। তাঁরাও মনে করতেন, পারভেজ ভাই গান নিয়ে খাটছেন, সুন্দরই হবে। তাঁরাও মন লাগিয়ে কাজ করতেন। তাই আমাদের মধ্যে আদান–প্রদান সুন্দর হতো।

 আজাদ রহমান আরও কিছু গান তৈরি করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর এই প্রস্থান আপনার মনোজগতে কী প্রভাব ফেলছে?

 গুণী কেউ মারা গেলে আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, একটা বড় লস হয়ে গেল। আমি বলব, আজাদ রহমানের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটা যুগের সমাপ্তি হয়েছে। তাঁর গানের সুর, গানের ধরন, কম্পোজিশন ছিল একেবারেই অন্য রকম। তাঁর গানের মধ্যে বাঙালিয়ানা যেমন খুঁজে পাওয়া যেত, তেমনি ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। কয়েক বছর ধরে বাংলা খেয়াল রাগ নিয়ে কাজ করছিলেন।

 আজাদ রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিনের সম্পর্কও বজায় ছিল আপনাদের মধ্যে। তাঁকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

 আজাদ যেমন গান তৈরি করেছেন, তেমনি গেয়েছেনও। তাঁর সৃষ্টি করা গান যাঁরা গেয়েছেন, তাঁরাও অতুলনীয়। আজাদ ইজ আজাদ। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, এই ধরনের অসম্ভব মেধাবী মানুষেরা অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসেন, তবে রেখে যান অসংখ্য সৃষ্টিকর্ম। যখন তাঁরা চলে যান, সেই জায়গা পূর্ণ হওয়ার নয়। মনে হয়, ওই কাজটা করার জন্যই তাঁরা পৃথিবীতে এসেছিলেন। আজাদ রহমানের ব্যাপারটা হচ্ছে, তাঁর প্রতিটা সৃষ্টিই অনবদ্য।

 আপনাদের শেষ কথা হয়েছিল কিংবা দেখা হয়েছিল?

 মাস ছয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। তবে আমাদের যোগাযোগ ছিল। গেল বছর যখন অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের কাছে বেড়াতে গেলেন, তখনও কথা হয়েছিল। এ ছাড়া ফেসবুকে যোগাযোগ নিয়মিত হতো। অনেক কিছু শেয়ার হতো, কথা বলার সময় প্রাণ খুলে হাসতেন। তাঁর মুখে হাসিটা লেগেই থাকত। দেখতাম, কোনো মিউজিশিয়ান ভুল বাজালেও রাগতেন না। খুব অসাধারণ একজন মানুষ, চমৎকার একজন ভদ্রলোক। তাঁর কোনো তুলনা হয় না।