জীবনটা এমনই, সবকিছু পাওয়াও যায় না, সব চিন্তা মেলেও না
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খানের ছেলে এবং সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর বংশধর স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক ও সুরকার শেখ সাদী খান এর আজ ৭২তম জন্মদিন আজ। ১৯৫০ সালের ৩ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেড়ে ওঠেন কুমিল্লায়। পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে তিনি চার হাজারের অধিক গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন। ১৯৬৯ সালে চারটা গান নিয়ে তাঁর প্রথম এইচএমভি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এর দুটো গান গেয়েছিলেন শওকত হায়াত খান, দুটো মৌসুমী কবির। ওই সময় সাবিনা ইয়াসমীনকে দিয়েও রেডিওতে গান করেন তিনি, এস এম হেদায়েতের লেখা সেই গান ‘শোনো, কোনো এক বন্দী পাখির কথা’। একই সময়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘যা যারে যা পাখি’ গানটি গাওয়ান ফওজিয়া খানকে দিয়ে। তাঁর তৈরি অসংখ্য গানের মধ্যে ‘তুমি রোজ বিকেলে’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘যা যারে যা পাখি’, ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’, ‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি’, ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, ‘জীবন মানে যন্ত্রণা’, ‘তোমার চন্দনা মরে গেছে’, ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও’ উল্লেখযোগ্য। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালে ‘ঘানি’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক বিভাগে এবং ২০১০ সালে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে ডেইলি স্টার সেলিব্রিটিং লাইফে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। জন্মদিনে আজ তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
প্রশ্ন :
শুভ জন্মদিন।
ধন্যবাদ। আজ আমার ৭২ বছর পূর্ণ হলো।
প্রশ্ন :
বয়সের কথা ভাবলে কেমন লাগে?
গভীরভাবে চিন্তা করলে তো ভাবি, জীবন থেকে আরেকটা বছর খসে গেল। সামনে আর কত দিনই বাঁচব। একজন মানুষ কত দিনই–বা বাঁচেন—৭০, ৮০, ৯০ বা ১০০, তারপর তো সবাইকে মরতে হবে। এই কথাগুলো মনের মধ্যে আসে। তখন জীবনের জন্য অনুশোচনা হয়। ভাবতে থাকি, হায় রে জীবন, কেনই–বা পৃথিবীতে এলাম। মানুষের জীবনে প্রাপ্তির কিন্তু কোনো শেষ নেই। চিন্তার শেষ নেই। আশারও শেষ নেই। স্বপ্নেরও শেষ নেই। স্বপ্ন দেখে, মানুষ চায় সারা জীবন বেঁচে থাকতে। অনেকে এমনটাও ভাবে না, ইশ্, সারাটা জীবন যদি বেঁচে থাকতাম! অনেকে আবার ভাবে, কোনো না কোনো একসময় তো মরতেই হবে। যত বেশি বাঁচব, তত বেশি হয়তো জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে পাপ-পুণ্য।
প্রশ্ন :
অনুশোচনা কেন হয়? এই মানুষই তো অল্প সময়ে চাইলেই তাঁর কাজের মাধ্যমে জীবনকে শত শত বছরও বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।
আসলে জীবনটা তো ক্ষণিকের। এই ক্ষণিক জীবনে মানুষেরই থাকে আশা-আকাঙ্ক্ষা। অনুশোচনা এই কারণে হয়, হায় রে জীবন, পৃথিবীতে না এলেই তো বুঝি ভালো হতো। ভাবনাচিন্তা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি—অনেক কিছুই ছোট্ট এই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। জীবন আছে বলেই পৃথিবীতে আমার সংসার হলো। স্নেহ, মায়া, মমতা—সবকিছুই হলো। জীবন না থাকলে তো এসব হতো না। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া কী? ভালোবাসা। সবচেয়ে বড় চাওয়া কী? আমিও মনে করি, ভালোবাসা। জীবনের জন্য প্রয়োজন হয় অনেক কিছু। মান-সম্মান যা–ই বলি, সবকিছুই তো লাগে। কিন্তু জীবনের চালিকা শক্তি তো ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে হয়ে যায় স্রষ্ঠাকে ভালোবাসা। মানুষ যদি মানুষকেই ভালোবাসতে না পারে, সে জীবন কখনোই জীবন হতে পারে না। আমি তো বলি, ভালোবাসতে বাসতে মরে যাও, বিলীন হয়ে যাও। জীবনটা আসলে কত দিনের, খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই হয়। আমার বাবা নেই, আম্মাও নেই, দাদা-দাদিসহ অনেকে চলে গেলেন। বড় ভাই নেই। একদিন আমিও চলে যাব। কত দিনই বাঁচব?
প্রশ্ন :
একটা দীর্ঘ জীবন পার করে এসেছেন। সে জীবনে প্রাপ্তি কেমন? আগামী জীবনে প্রত্যাশা কী?
জীবনে প্রাপ্তি এসেছে। সফলতা এসেছে। জীবনের এই পর্যায়ে আসতে অনেক বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। তারপরও...হয়তো নিজের ৫ বা ১০ তলা বাড়ি করতে পারিনি বা হয়নি, এটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু মানবজীবনে সবই পেয়েছি, সুসন্তানও পেয়েছি। ছোট ভাইবোনদের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাদের জন্য ত্যাগ স্বীকারও করেছি। ত্যাগ স্বীকার করে ভালো লেগেছে। কারণ, তারা তো ভালোভাবে আছে। জীবনটা এমনই। সবকিছু পাওয়াও যায় না, সব চিন্তা মেলেও না, হয়ও না। তারপরও কিছু স্বাদ জাগে না, পৃথিবীটা যদি সুন্দর হয়ে উঠত। আমরা সবাই যদি ভালোবাসা ছড়িয়ে পৃথিবীতে থাকতাম! এখন তো পৃথিবীতে যে অবস্থা, পৃথিবীটাকে নরকসমান মনে হয়। তখনই মনে হয়, এই জীবন তো চাইনি। আমার তো মনে হয়, এখন যা হচ্ছে, এসব আমাদের কর্মফলের অভিশাপ। এই অভিশাপের কারণে আমরা যন্ত্রণাগ্রস্ত।
প্রশ্ন :
কী জীবন চেয়েছিলেন?
আমার তো মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে যদি দেখতাম, পৃথিবীতে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। সবাই একটা নিয়মে চলছে। তখন কিন্তু মানুষের চিন্তাভাবনার উন্নতির পাশাপাশি কাজের গতিও বেড়ে যায়। চিন্তা আর ভালোবাসার গতিও বেড়ে যায়।
প্রশ্ন :
আপনার সুর করা একটি গান হচ্ছে ‘জীবন মানে যন্ত্রণা’। আপনার কাছে জানতে চাই, জীবন মানে কী?
জীবন মানে আনন্দও আছে, আছে বেদনাও। এই জীবনে মানুষকে কিন্তু যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। সবাই তো আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সবাই তো রাজার পুত্রও হয় না। জীবনটা একটা যুদ্ধ।
প্রশ্ন :
মুত্যু নিয়ে আপনার উপলব্ধি হয় কি?
এই বয়সে এসে আমার মনে হয়, মৃত্যুটাই বোধ হয় সবচেয়ে শান্তির। মরার পর জাগতিক জীবনের কোনো চিন্তা থাকে না, ভাবনা থাকে না। কোনো পরিকল্পনা থাকে না, মায়া-মমতা কিছুই থাকে না, থাকে না কোনো চাওয়া-পাওয়া। মৃত্যু একটি ঘুম, চমৎকার একটা ঘুম। সবকিছু ছেড়েছুড়ে একসময় চলে যাওয়া। মৃত্যু অন্য জীবনে অনন্ত ঘুম। সেই ঘুমের মধ্যে কী হবে না হবে, তা তো শুধু একমাত্র স্রষ্টাই জানেন।
প্রশ্ন :
মৃত্যু নিয়ে ভাবেন কি?
ছোটবেলা থেকে আমার স্পিরিচুয়াল ভাবনা ছিল। বয়স বাড়তে বাড়তে এই স্পিরিচুয়াল ভাবনাটা অনেক বেশি ডেভেলপ হয়েছে। তাই মাঝেমধ্যে ভাবনার অনেক গভীরে চলে যেতে পারি। গভীরে যখন যাই, চোখ দিয়ে টপটপ করে শুধু পানি পড়ে।
প্রশ্ন :
আপনার আগের প্রজন্ম সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। পরের প্রজন্মের খবর কী বলুন?
আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে রওনক ফেরদৌস খান জোনাক এমবিএ পড়াশোনা করে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে পরে পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে গেছে। ১৫ বছর ধরে সেখানেই আছে। মেয়ে সাগুফতা জাবীন খান বাংলাদেশেই আছে, একটি ব্যাংকে কর্মরত।
প্রশ্ন :
আপনার সন্তানেরা গানে নিয়মিত হলেন না কেন?
আমার ছেলে কিন্তু একসময় খুব ভালো গান গাইত। পেশাদারভাবে গান গাইতে হবে, এটা জোনাকও চিন্তা করেনি, আমিও করিনি। তবে রেডিও এবং টেলিভিশনের সে এনলিস্টেড শিল্পী। বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানও করেছে। চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছে। আমাদের যত সিনিয়র আর্টস্ট আছে, প্রায় সবার সঙ্গে গান গেয়েছে। রুনা লায়লা দিয়ে তাঁর গানের জীবন শুরু, ‘প্রেম দিওয়ানা’তে। সব মিলিয়ে ১৫-১৬টা চলচ্চিত্রে গান গেয়েছে সে। সাবিনা ইয়াসমীন, কনকচাঁপা, শাকিলা জাফরসহ অনেকের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছে। জীবনে কখনো যাতে আফসোস না থাকে, আমার বাবা একজন বড় সংগীত পরিচালক, আমারে তাঁদের সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিল না। তাই আমি গাইয়েছি। কিন্তু আমার ছেলে বলছিল, ‘আসলে আব্বা, তোমাদের লাইনটা সুন্দর কিন্তু সিস্টেম্যাটিক নয়, উচ্ছৃঙ্খল একটা লাইন। এখানে একে অপরকে অকারণে হিংসা করে। বেশির ভাগ মানুষের কথাবার্তা ঠিক নেই। ব্যবহারও ভালো নয়। আমি সংগীত ভালোবাসি, গান করব, তবে কখনো পেশা হিসেবে নেব না।’ আমার ছেলেটার গলা খুব ভালো ছিল। নিতিন মুকেশের একটা ছাপ ছিল। ওর গাওয়া ছবির গানগুলো এখনো বিভিন্ন সময় বাজতে শুনি।
প্রশ্ন :
আর মেয়ে?
মেয়েকে আমি নিজেই গানে দিতে চাইনি। আমি গানবাজনা করে সারা দিন বাউন্ডুলের মতো বাইরে বাইরে থাকি। মাকেও যদি তার পেছনে পেছনে সারা দিন দৌড়াতে হয়, আরেক যন্ত্রণা না। পড়াশোনার দিকে তাই গুরুত্ব দিয়েছি। পেশা হিসেবে গান বেছে না নেওয়াতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমি হ্যাপি। এই দেশের সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষকে আমাদের সময় খুব একটা সম্মান দেওয়া হয়নি। সম্মান দিতে কৃপণতা করত। তবে এখন দেওয়া হয়।
প্রশ্ন :
পাঁচ দশকে জ্যেষ্ঠ অনেক সংগীতশিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন। কাদের সঙ্গে আপনার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ছিল বেশি?
আমি সুবীর নন্দীকে নিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। শাম্মী আখতার, আবিদা সুলতানা, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। যদিও আমি খুরশীদ আলমের সঙ্গে কাজ কম করেছি, তারপরও তাঁর সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগত। বাইরের দেশে হৈমন্তী শুক্লা, আশা ভোঁসলে, কুমার শানু। বাংলাদেশে প্রথম আমিই তাঁদের দিয়ে গান গাওয়াই। তাঁদের গাওয়া গানগুলো আলোড়িত যেমন হয়েছে, তেমনি হৃদয়গ্রাহীও হয়েছে। মান্না দেকে দিয়ে ‘সুখের সন্ধান’ ছবিতে ‘বলো মা কেন এত ক্লান্ত লাগে’ গানটি করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে গান করতে গিয়ে শুরুতে আমার প্রচণ্ড একটা ভয় ছিল। কিন্তু তিনি যখন গাইলেন, আমি প্রচণ্ড রকম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি। তাঁদের সঙ্গেও কাজ করে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি—তাঁদের আচরণ, গাওয়ার ধরন, গানের প্রতি মায়া-মমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ফেরদৌসী রহমানের মতো শিল্পীকে দিয়ে গান করিয়েও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি।
প্রশ্ন :
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়েও আপনি নিয়মিত কাজ করছেন। তাঁদের নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
এই প্রজন্মের মধ্যে যারা এসেছে, তাদের মধ্যে অনেক শিল্পী বেশ ভালো। মেয়েদের মধ্যে স্বরলিপি, কোনাল, নন্দিতার গাওয়া আমার ভালো লাগে। ছেলেদের মধ্যে ইউসুফ, সাব্বির, মোমিন বিশ্বাস, বাউল মনির পছন্দের। সমস্যাটা, এদের অনেকেরই নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থান আছে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন :
কেন মনে হচ্ছে না?
তাদের অনেকের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। তারা গান গাইবে নাকি সুর করবে, নাকি সংগীত পরিচালনা করবে, নাকি রেকর্ডিং করবে। তিন-চারটা কাজ একসঙ্গে করছে! কিন্তু তাদের বেছে নিতে হবে একটা। সব কাজের কাজি তো হওয়া যায় না। তাদের এটা বুঝতে হবে, মানুষ যেহেতু আমাকে গ্রহণ করেছে, আমার গলা ভালো, গানটা নিয়েই আমি থাকি না। তরুণদের প্রপার গাইডেন্স দরকার। নিজেকে নিজে গাইড করতে হবে। গুরুরও পরামর্শ নিতে হবে। তারা কিন্তু সবাই ট্যালেন্টেড। নিজেদের গান বেশি বেশি করতে হবে। কাভার গান গেয়ে জীবন পার করে দিলে তো চলবে না। সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে না নেওয়ার কারণে তরুণদের অনেকে ছিটকে পড়ে।