গতকাল রোববার ৮৩ বছর বয়সে চলে গেলেন কত্থক নাচের গুরু, নৃত্যপরিচালক পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। বাংলাদেশে তাঁর প্রথম ছাত্র ছিলেন নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ। গুরুর মৃত্যুতে তাঁর স্মৃতিচারণ করলেন বাংলাদেশের এই শিল্পী।
প্রশ্ন:
পণ্ডিতজি বিদায় নিলেন।
মাথার ওপর থেকে একটা ছায়া সরে গেল, একটা শক্তি চলে গেল।
প্রশ্ন:
শেষ কথা হয়েছিল কবে?
১৭ ডিসেম্বর। যতবার ফোন করতাম, ততবারই বলত, শিবলী আমাকে একবার বাংলাদেশে নিয়ে যা। আমি বলেছিলাম, করোনা চলে গেলেই আপনাকে নিয়ে আসব। সেদিন তাঁর স্বর খুব দুর্বল লাগছিল, শুনে ভালো লাগছিল না। যেকোনো বড় শো করতে যাওয়ার আগে সব সময় তাঁর দোয়া চেয়ে নিতাম। বিজয় দিবসে সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানের আগেও কথা বললাম, আশীর্বাদ চাইলাম। সেদিনও তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন, সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন, সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখনো তাঁর কণ্ঠ খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছিল। তাঁর ছেলে আমাকে বলেছিলেন, বাবুজির শরীরটা ভালো নেই। আমার এক গুরু বোনকে ফোন করে জানতে পারলাম, গুরুজির ডায়ালাইসিস চলছিল। শরীর ভীষণ খারাপ, সেটা তাঁরা কাউকে জানাতে চাননি।
প্রশ্ন:
শেষ বিদায় জানাতে যাচ্ছেন?
ভেবেছিলাম তাঁর শেষকৃত্যে যাওয়ার সুযোগ পাব। সারা পৃথিবীতে তাঁর বহু ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে আছেন। তাঁরাও নিশ্চয়ই আসতে চাইবেন। কিন্তু ভারতের পরিস্থিতি ভালো না। সেখানে গিয়ে নামলেই এক সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। সেখানকার সরকার গুরুজির শেষকৃত্যের জন্য তাঁর পরিবারের মাত্র ২০ জনকে একত্র হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। কোনো স্টুডেন্ট যেতে পারছেন না, সবাই বাড়িতে বসে কাঁদছেন।
প্রশ্ন:
আপনাকে বিরজু মহারাজের কাছে কে পাঠিয়েছিলেন?
আমি যখন বৃত্তি নিয়ে লক্ষ্ণৌতে নাচ শিখতে গেলাম, আমার গুরু ছিলেন পূর্ণিমা পাণ্ডে। তিনি বললেন, এখানে পড়ে থেকে তোমার লাভ হবে না। তোমার যে মেধা, সেটা বিরজু মহারাজের কাছে গেলেই কাজে লাগবে। তিনি বিরজু মহারাজকে চিঠি লিখে দিলেন যে বাংলাদেশের এই ছেলেটা অনেক মেধাবী। আপনি দয়া করে তাঁকে নিয়ে নিন। দিদির পূর্বপুরুষ ছিল বরিশালের। বিরজু মহারাজ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তরুণ, বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে তাঁর জানা ছিল। আমি তখন নাচের কিছুই জানি না। তিনি চিঠি পড়ে বললেন, শেখ মুজিবের দেশ থেকে এসেছিস, খুব ভালো। তবে আমি তোকে ছয় মাস দেখব। পরে তিন মাস পরই দেখলাম তিনি আমার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট। তাঁর কাছে অনেক দেশের শিক্ষার্থী ছিলেন, আমি প্রথম বাংলাদেশি।
প্রশ্ন:
শিক্ষক হিসেবে তাঁকে মূল্যায়ন করুন।
তিনি একজন সাধক। তিনি দ্যুতি ছড়াতেন। কেবল নাচ শেখানো নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য তিনি আমাদের আলোকিত করেছেন। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ৯৯ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী সফল মানুষ হতে পেরেছেন। সবাই যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে ঝলমল করছেন। তিনি নিজে ছিলেন একটি হিরের টুকরো, তাঁর দ্যুতি এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি খারাপ ছাত্র নিতেন না, যে কয়জনকে নিয়েছিলেন, তাঁর স্পর্শে সেই ছাত্ররাও ভালো হয়ে যেতেন। তাঁর প্রতিটি কথা মূল্যবান, আমরা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এত বড় মানুষ, লোকে প্রশংসা করলে ভীষণ লজ্জা পেতেন, মাথা নিচু করে রাখতেন। এই শিক্ষাটাও আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তাঁর কাছে না গেলে হয়তো মানুষ হতেই পারতাম না।
প্রশ্ন:
গত শতকের আশির দশকে আপনি তাঁর কাছে নাচ শিখতে গিয়েছিলেন। হোস্টেলজীবনের কথা মনে পড়ে?
ওই সময় ভারতে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হতো। স্টুডেন্টদের জ্বর হলে তিনি দেখতে আসতেন। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। যাওয়ার সময় বালিশের নিচে এক শ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে যেতেন, যাতে আমরা ফল খেতে পারি, দুধ খেতে পারি। সেসময় এক শ টাকা অনেক। এই শিক্ষাটাও আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি কেবল আমার শিক্ষক নন, আমার বন্ধু, আমার পিতা। বন্ধুর সঙ্গে মানুষ যেভাবে রসিকতা করে, দুষ্টুমি করে, আমি তাঁর সঙ্গে সে রকম করতাম। আমি তাঁর মনজয় করতে পেরেছিলাম।
প্রশ্ন:
আপনার গুরু ভাই-বোনেরা কোথায় আছেন?
বাংলাদেশে আছে মুনমুন আহমেদ, কচি রহমান, সাজু আহমেদ। ভারতে মালতি শ্যাম প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান, ম্যানচেস্টারে কাজল শর্মা, মুম্বাইতে মাধুরী দীক্ষিত, ভারতের শ্বাশতী সেন তো নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছেন। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন নাচের জন্য, গুরুর সেবায়। শেষবার ডায়ালাইসিস করে তাঁর বাড়িতে গিয়েই উঠেছিলেন মহারাজজি। কাল রাতে সেখানেই তাঁর শরীরটা খারাপ হয়ে যায়।
প্রশ্ন:
তাঁর পরিবার?
মহারাজজির দুই ছেলে জয়কীষাণ মহারাজ, দীপক মহারাজ, মেয়ে মমতা মহারাজ। তিনজনই প্রতিষ্ঠিত নৃত্যিশিল্পী। মা ছিলেন খুব সাধারণ একজন নারী। বড় ঘোমটা টেনে রাখতেন। আমাদের সামনে খুব কমই আসতেন তিনি। অনেক দিন আগে চলে গেছেন।
প্রশ্ন:
নৃত্যগুরু হিসেবে আপনি তাঁর কোন কোন জায়গাগুলো অনুসরণ করেন?
তিনি খুব মজা করে ক্লাস নিতেন, হাসাতেন। সব সময় বলতেন, ছাত্রদের লাইভলি রাখবে। সেটাই মঞ্চে প্রতিফলিত হবে। গম্ভীরভাবে নাচ শেখালে তারাও গম্ভীরভাবে নাচ করবে। আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো কত্থক সন্ধ্যা করেছি, সবগুলো তাঁকে উৎসর্গ করেই করেছি। মঞ্চে উঠলে এক পাশে তাঁর একটা ছবির নীচে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি। তাঁকে আমি সব সময় মাথায় তুলে রাখি। তাঁকে আমি অন্তরে ধারণ করি। যতবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, আমার বাড়িতে এসেছেন। আমার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধার এই ব্যাপারগুলো আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি।