ভালো গান হলে শ্রোতারা শিল্পীকে নিরাশ করবেন না: শাকিলা জাফর
বাংলাদেশের আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী শাকিলা জাফর। আশির দশকের শুরু থেকে গানের জগতে তাঁর সফল পদচারণ। তিনি এখন পর্যন্ত অসংখ্য মনে রাখার মতো গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। সংগীতজীবনের শুরুর গল্পসহ বর্তমান সংগীত জগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

গানের জগতে শুরু...
এটা বলতে গেলে একদম ছোটবেলায় ফিরে যেতে হবে। মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম। এমন একটি পরিবারের মেয়ে হয়ে বাসার বাইরে গিয়ে গান করার চিন্তাটাই ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাসের ছুটিতে বাবা আমাকে গান শেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী হন। তাঁর আগ্রহে শ্রদ্ধেয় মিথুন দের কাছে গানের তালিম নিতে শুরু করি। গান শেখানোর একটা পর্যায়ে ওস্তাদজি বাবাকে অনুরোধ করেন, আমাকে যেন সংগীতবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি নানাভাবে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন যাতে আমি সংগীতসংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। সেই থেকে আমার সংগীতজীবনের যাত্রা শুরু। একটা সময়ে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রস্তাব আসা শুরু হলো। চলচ্চিত্রে গান করার ব্যাপারে প্রথমে পরিবারের সদস্যরা নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। শুরু থেকেই আমি সময়ের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমি আমার গায়কি ও পোশাকে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এটা সব সময় অব্যাহত থাকবে।
বর্তমান সময়ের গানগুলো কি আগের মতো আবেদন তৈরি করতে পারছে...
আগে শিল্পীদের ব্যস্ততা ছিল বিটিভিকেন্দ্রিক। একটা চ্যানেল হওয়ার কারণে তখন মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে সব ধরনের অনুষ্ঠান দেখতেন। আর অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্টরাও অনেক যত্ন নিয়ে অনুষ্ঠান বানাতেন। অনুষ্ঠানের মানের ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। শিল্পীরাও দর্শক-শ্রোতাদের নিজেদের সেরাটুকু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সবকিছু মিলিয়ে একটা গান কিংবা অনুষ্ঠান অন্য রকম একটা উচ্চতায় চলে যেত। এখন আগের মতো ভালো গান হচ্ছে না—এটা মানতে রাজি নই আমি। তবে এটা ঠিক যে, এখন বেশির ভাগ গান দীর্ঘ সময় ধরে শ্রোতাদের কাছে আবেদন রাখতে পারছে না। আমি বরাবরই শুদ্ধতায় বিশ্বাস করি। আজকাল অটো টিউনার দিয়ে গান করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটাকে আমি সমর্থন করি না। হয়তো এই কারণে এই সময়ের অনেক শিল্পীর গানে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠছে না। আমি মনে করি, অটো টিউনার দিয়ে গান করে শিল্পী নিজের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আর নিজের সঙ্গে প্রতারণা করার পাশাপাশি সে শ্রোতাদের সঙ্গেও প্রতারণা করে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা কথা সত্য যে, বিটিভি একমাত্র চ্যানেল হওয়ার কারণে দর্শকের মনোযোগ পাওয়াটা অনেক সহজ ছিল। মনে আছে, বিটিভিতে কোনো অনুষ্ঠান করার পরদিন অনেক প্রশংসা পেতাম। কারণ বেশির ভাগ মানুষই অনুষ্ঠান দেখতেন। এখন সবাইকে অনুষ্ঠানের সময়সূচি জানানোর পরও দেখার সময় পান না। সেদিক থেকে বলতে হয়, এই প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক দুর্ভাগ্যবান। অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের প্রমাণ করতে হয় নিজেকে। তবে এটা ঠিক, ভালো গান হলে শ্রোতারা শিল্পীকে নিরাশ করবে না। হোক সে নতুন প্রজন্ম কিংবা আগের প্রজন্ম। সবকিছুর আগে গুণগত ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে।
অপূর্ণ ইচ্ছা...
আমার শুরুটা হয়েছিল উচ্চাঙ্গসংগীত দিয়ে। বাংলাদেশ বেতারে উচ্চাঙ্গসংগীত বিভাগে জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করেছিলাম। এখন বিষয়টা মনে পড়লে খুব কষ্ট পাই। অনেকে আবার আমার কাছে অভিযোগ করেন, কেন আমি খেয়াল, ঠুমরি কিংবা টপ্পার কোনো অ্যালবাম করলাম না? তখন মনে হয়, আমি শ্রোতাদের বঞ্চিত করেছি। নিজেকে বঞ্চিত করেছি। হয়তো সামনে সুযোগ পেলে এই অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করব।
সংগীত জগতের বর্তমান অবস্থা...
সেই সময়ে আমরা যাঁদের কাছে গান শিখেছি, যাঁদের সুরে গান করেছি, তাঁদের অনেক অনুরাগী ছিলাম। প্রতিনিয়ত তাঁদের অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। তাঁরা আমাদের যেমন অনেক স্নেহ করতেন, আমরাও তাঁদের অনেক শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু এখনকার সংগীতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সেই বিনয়-শ্রদ্ধা খুব একটা দেখা যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, কিছুদিন আগে আমি এই প্রজন্মের একজন সুরকারের অনেক অনুরোধে স্টুডিওতে গান গাইতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেই সুরকার নেই। আমার কণ্ঠ রেকর্ড করবেন সাধারণ একজন রেকর্ডিস্ট। আমি সেখান থেকে রেকর্ড না করেই চলে এসেছিলাম। গান আসলে গুরুমুখী বিদ্যা। এই বিদ্যাকে শ্রদ্ধা না দিলে, সম্মান না দিলে তা কোনো দিন ধরা দেবে না। সংগীত অনেক সাধনার বিষয়। এই প্রজন্মের সংগীত অনুরাগীদের এই কথাটুকু মনে রাখতে হবে।
যাঁদের গান ভালো লাগে...
যাঁরা শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করেন, যাঁরা ভালো গান করেন, আমি তাঁদের সবার ভক্ত। প্রখ্যাত শিল্পীদের পাশাপাশি এই প্রজন্মের শিল্পীদের অনেকের গানই আমার ভালো লাগে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রিয়াংকা আমার ভীষণ পছন্দের।
বর্তমান সময়ের শিল্পী ও শ্রোতাদের প্রতি...
বর্তমান সময়ের শিল্পীদের সবাইকে আমি শুধু বলতে চাই, তোমরা নিয়মিত রেওয়াজ করো। যত বেশি রেওয়াজ করবে, নিজেকে ততই সমৃদ্ধ করতে পারবে। রেওয়াজ নিয়ে আমি কখনোই আপস করতাম না। বাসায় কোথাও সুযোগ না পেলে রান্নাঘরেও রেওয়াজ করতাম। আর শ্রোতাদের প্রতি অনুরোধ, দয়া করে আপনারা অনেক অনেক বেশি গান শুনবেন।