'গান ছাড়া আর কিছু করব ভাবিনি'

সংগীতশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী’র গানের সঙ্গে সখ্য ছোটবেলা থেকেই। স্কুলশিক্ষিকা মা-ই তাঁকে গানের ক্লাসে ভর্তি করে দেন। পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম অ্যালবাম ‘প্রতীক্ষা’। ছয় বছর বিরতির পর লালনের গান নিয়ে একক ‘অপার হয়ে বসে আছি’। আর আসিফের সঙ্গে তিনটি দ্বৈত অ্যালবাম ‘মন ছুঁয়ে যাও, চলো যাই অজানায়, ফিরব না আজ বাড়ি। আর কয়েকটি মিশ্র অ্যালবাম। চলচ্চিত্রে নিয়মিত প্লেব্যাক, স্টেজ শো এ নিয়েই মুন্নীর ব্যস্ততা। ঈদের অনুষ্ঠান, প্রকাশিতব্য অ্যালবাম, সংগীতভাবনা ও পরিবারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের।

দিনাত জাহান মুন্নী
দিনাত জাহান মুন্নী

ঈদের কতগুলো অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন?
খুব যে অনুষ্ঠান যে করেছি তা কিন্তু না। তবে দেশের প্রথম সারির সব চ্যানেলের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে বেশির ভাগে গানই গেয়েছি। গেম শোতেও অংশ নিয়েছি। পাশাপাশি এবার বিটিভির একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করেছি।

কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
ভালো লেগেছে সবগুলো। একটা থেকে অন্যটা আলাদা। খুব বেশি মিল নেই। এমন অনুষ্ঠান করেছি যেটিতে সবাই একেবারে নতুন। এদের কারওর সঙ্গে আগে কোনো দিন দেখা হয় নাই। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এটিএন বাংলার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে। এটিতে ছিলেন বাপ্পা মজুমদার, ফাহমিদা নবী ও এস আই টুটুল। এই অনুষ্ঠানে বাপ্পা দা’র সঙ্গে দ্বৈত গান গাওয়াটা ছিল অনেক আনন্দের। সংগীতপরিচালক শওকত আলী ইমন ও আলী আকরাম শুভকে নিয়ে বিটিভির ‘স্বর্ণালি-বর্ণালি’ অনুষ্ঠান করেছি। এই অনুষ্ঠানে তাঁদের গানগুলো গেয়েছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা। চ্যানেল আইতে কোনালের পরিচালনায় ‘গানে গানে’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েও ভালো লেগেছে।

কোন অনুষ্ঠানকে সবচেয়ে বেশি মৌলিক মনে হয়েছে?
ঈদে চ্যানেলগুলো অনেক অনুষ্ঠান নির্মাণ করে। খুব বেশি নতুনত্ব কিছু আছে তা বলা যাবে না। নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করার সংখ্যাটা একেবারেই নেই। হয়তো চ্যানেল বেশি হওয়াতে এটা আরও বেশি সম্ভব হচ্ছে না। আমি যেহেতু গানের মানুষ, তাই বলতে পারি, গান নিয়ে ভিন্নধর্মী কিছু কমই ভাবা হচ্ছে। হয়তো আইডিয়ার অভাব। আমাদের একটা কমন প্রবলেম হচ্ছে, কোনো অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা জমা দেওয়ার সময় বাজেটটা জুড়ে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, আমাদের চিন্তার জগৎটা বড় করতে পারলে বাজেট বড় কোনো বাধা না। তা ছাড়া সব ভাবনার মধ্যেই কেন যেন মনে হয় দেশপ্রেমটা কম। এটা খুব দুঃখজনক। আসলে আমাদের লক্ষ্যটা কী, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

আপনার ‘ও প্রিয়’ নামে একটা অ্যালবাম প্রকাশের কথা। সেটির কী অবস্থা?
‘ও প্রিয়’ অ্যালবামটি গত বছর রোজার ঈদে অ্যালবামটি প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। আমার খুব ইচ্ছে, ভালো করে অ্যালবামটির প্রকাশনা করার। এখন গান প্রকাশের নতুন কিছু সিস্টেম চালু হয়েছে। পুরো বিষয়গুলো বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। আমি ভিন্নধর্মী কিছু করতে চাই। ঈদের পর দেশের বাইরে কিছু শো আছে। সেখান থেকে ফিরে নতুন অ্যালবাম শ্রোতাদের হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে। একটা গান যেভাবে হিট হয় সেভাবে অ্যালবাম কেউ কিনতে চায় না। যা খুব দুঃখজনক। মানুষ গান ডাউনলোড করে নিচ্ছে।


স্কুল শিক্ষিকা মা-ই কী আপনার গান শেখার অনুপ্রেরণা?

দিনাত জাহান মুন্নী
দিনাত জাহান মুন্নী


হ্যাঁ, আমার মা-ই আমাকে গানের শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান। গান শেখার অনুপ্রেরণা তো মা অবশ্যই, আমার একটা বোনও ছিল। সেই বোন আমাকে সবকিছুতে উৎসাহ দিত। সে মারা গেছে।

ছোটবেলায় কি হতে চেয়েছিলেন? বাবা-মার আপনাকে নিয়ে কি স্বপ্ন ছিল?
পড়াশোনা শুরু করার আগেই আমি গান শুরু করেছিলাম। জীবনের লক্ষ্য ভাববার আগেই গানের মধ্যে ঢুকে পড়ি। গান ছাড়া কিছু করব এটা ভাবিনি। ছোটবেলায় আমি জাতীয় পর্যায়ে পাঁচবার পুরস্কার পেয়েছিলাম। গানের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনেক কষ্টও করেছি। তা নিয়ে কোনো আফসোস নাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবা-মা দুজনেই চেয়েছিলেন আমি সংগীতশিল্পী হই। আমার পুরো পরিবার খুব গান ভালোবাসত। আমাকে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, ভাই-বোন, মামা-চাচা সবাই অনেক বেশি উৎসাহ দিত।

তাহলে গানের জগতে এসে ভুল করেননি?
আমাকে যত অপশনই দেওয়া হোক না কেন আমি গানকেই বেছে নেব। ছোটবেলা থেকে আর কোনো লক্ষ্যই ছিল না। আমি চেয়েছি, আমার পরিবারও চেয়েছিল যেন শিল্পী হই। পড়াশোনার জন্য আমি একটা সময় ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার পর মা আমাকে প্রথমেই ছায়ানটে ভর্তি করিয়ে দেন। আমার জীবনের সব স্বপ্ন গানকে ঘিরেই। গান ছাড়া কোনো কিছুই ভাবতে পারতাম না। জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম তাই তো হয়েছি। তাই মনে হয় না গানের জগতে এসে ভুল করেছি।


চলচ্চিত্রের গানে আপনার টার্নিং পয়েন্ট কোনটি?

আমাকে ১৯৯৮ সালে প্রথম প্লেব্যাকে কাজ করার সুযোগ দেন শওকত আলী ইমন। কবির বকুলের লেখা ও শওকত আলী ইমনের সুরে। ওই গানটি ছিল ‘জননেতা’ ছবির | দ্বিতীয় গানটিও এই জুটির ছবির, নাম ‘দুর্ধর্ষ সম্রাট’। এর কিছুদিন পর আমি ডাক পাই গুণী সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলীর। তিনি আমাকে একসঙ্গে দুটো গান করান। এরপর ডেকেছিলেন, আলম খান, আলী হোসেন। আর পাশাপাশি ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভ-এস আই টুটুল নিয়মিত প্লেব্যাক করিয়েছেন। তবে আমি মনে করি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি ছবির ‘ও প্রিয়’ গানটি চলচ্চিত্রের গানের টার্নিং পয়েন্ট। ‘ও প্রিয়’ গানটি দিয়ে আমি শ্রোতাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি।

দিনাত জাহান মুন্নী
দিনাত জাহান মুন্নী

গান গেয়ে প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন কবে এবং কত?
সাত বছর বয়সে চাঁদপুরে ‘কচি কাঁচার আসরে’ গান শুনে ঢাকা থেকে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই অনেক উপহারসহ পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর বঙ্গভবনে পাই পাঁচ হাজার টাকার পুরস্কার। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ ওই পুরস্কার দিয়েছিলেন। এরপর বাংলাদেশ বেতার থেকে ১৯৯৬ সালে প্রথম পারিশ্রমিক হিসেবে দেড়শো টাকা পেয়েছিলাম।

প্রথম পারিশ্রমিকের টাকা কী করছিলেন?
বঙ্গভবনে পাওয়া পুরস্কারের টাকা দিয়ে ন্যাশনাল প্যানাসনিক টুইন ওয়ান ও ফরিদা পারভীনের একটা অ্যালবাম কিনেছিলাম।

গানের জন্য দেশে ও বিদেশে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লাগার অভিজ্ঞতা বলবেন কী?
সম্প্রতি একটা সরকারি সফরে কুয়েতে গিয়েছিলাম। এর ঠিক আগে গিয়েছিলাম সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, কানাডা ও আমেরিকায়। আমার মনে হয়েছে, কুয়েতের সফরটা সবচেয়ে বেশি সম্মানজনক ও ভালো লাগার। পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি। প্রতিটি দেশে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু কুয়েত সফরটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। কুয়েতের প্রত্যেকটা টেলিভিশনে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার হয়েছে। পত্র-পত্রিকাতে আমার গান দিয়ে খবরের শিরোনাম করা হয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক ভালো লাগার।

গানের পাশাপাশি উপস্থাপনাও করছেন। এ ব্যাপারে আপনার আগ্রহ জন্মায় কীভাবে?

মাছরাঙা টিভির রাঙা সকাল অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা হিসেবে আমার পরিচিতি এনে দিয়েছে। উপস্থাপনায় আমার কোনো আগ্রহ কোনো দিনই জন্মায়নি। চ্যানেলের অনুষ্ঠান পরিচালকরা আমাকে দিয়ে উপস্থাপনা করিয়েছেন। তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে, আমাকে দিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করানো সম্ভব। বিশ্বাস করেন, আমি আমার মতো কথা বলে যাই। ওটাই হয়তো মানুষের ভালো লাগে।


দুই মেয়ে ও এক ছেলেকেও আপনি কী গানের জগতে দেখতে চান?

আমার বড় মেয়ে প্রেরণা এরই মধ্যে গান শুরু করে দিয়েছে। পরিচিতজনদের যাঁরাই ওর গান শুনেছে সবাই বেশ প্রশংসা করেছে। কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে সে আমেরিকা বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানকার টাইম টিভি তার ৪০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ করেছে। শুনেছি ঈদে সেটি প্রচার করবে। সে ভিন্ন ঘরানার গান করে। ওর অ্যালবামের কাজও শুরু হয়েছে। ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু তাঁর নিজ দায়িত্বে প্রেরণার অ্যালবামের কাজ শুরু করেছেন। ইউটিউবে তার (প্রেরণার) অনেক সাবস্ক্রাইবার। আমরা কোনো কিছু তার ওপর চাপিয়ে দিইনি। ছোট মেয়ে প্রতীক্ষা র‍্যাপ পার্ট খুব ভালো করে। ওরা দুই বোন যখন একসঙ্গে র‍্যাপ পার্ট করে তখন চোখ বন্ধ করে মনে হয় কোনো ব্যান্ডের গান শুনছি। দুই মেয়ের কিন্তু ক্ল্যাসিকাল সেন্সও খুব ভালো। গানকে তাঁরা কীভাবে নেবে তা তাদের ও পরই ছেড়ে দিয়েছি। তবে একটাই চাওয়া, আমাদের পরিচয়ের চেয়ে ওদের পরিচয়টা যেন অনেক বড় হয়। সবাই যেন আমাদের দেখে বলে, ওই তো প্রেরণা-প্রতীক্ষার বাবা-মা। এটাই শুনতে ভালো লাগবে। আমরা চাই, স্বতন্ত্র পরিচয়ে তারা বড় হোক।


আপনার জীবনসঙ্গী গীতিকার কবির বকুল। তাঁর লেখা গান গাইতে কেমন লাগে?

দিনাত জাহান মুন্নী
দিনাত জাহান মুন্নী


এটা সত্যি, কবির বকুলের সবকিছুই আমার জানা। তার শব্দচয়ন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। কোনো স্টুডিওতে যখন গান হাতে পাই সেই কাগজের ও পর যদি কারও নাম নাও লেখা থাকে, তারপরও বুঝতে পারি সেটা কবির বকুলের লেখা গান। এটাও সত্যি যে, একটা গান যখন আমি হাতে পাই, তখন ভাবি না, এটা কার লেখা গান। আমি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানসহ বাংলাদেশের খ্যাতনামা অনেক গীতিকারের লেখা গানে যেমন কণ্ঠ দিয়েছি ঠিক তেমনি এই প্রজন্মের গীতিকারদের লেখা গানেও কণ্ঠ দিয়েছি। এখানে নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। আমি সবার গান গাইতেই স্বচ্ছন্দ।

গানে আপনার পথ চলায় আপনার স্বামীর ভূমিকা ...
এটা একেবারেই অন্যরকম। বিয়ের আগে মা আমাকে সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। আগেই বলেছি, আমার মা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। শুনেছি, চাকরিজীবনে তিনি কোনো ছুটি নিতেন না। এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটিও। মা শুধু তখনই ছুটি নিতেন, যখন আমার কোনো অনুষ্ঠান থাকত। কারণ, আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তিনিই যেতেন। বিয়ের পর আমার স্বামীই আমাকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা সব দিয়েছেন। আমি মফস্বল থেকে ঢাকায় আসা একটা মেয়ে। ঠিকমতো ঢাকা শহর চিনিও না। সেই আমি হয়তো গানের জগতের অনেক কিছুই বুঝতাম না। কেউ কেউ বলে, গানের জগতে অনেক অন্ধকার আছে। হয়তো সেগুলোও আমাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারত। বাট আই অ্যাম সো লাকি বিকজ অব মাই হাজব্যান্ড। আমার জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমার স্বামী যেভাবে গাইড করেছে, উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তা আসলে বলে শেষ করা সম্ভব না। হয়তো আমি রাতারাতি তারকাখ্যাতি পাইনি। একটা জায়গায় আমি অনেক বেশি গর্ববোধ করি। আমি জানি না কেন তবে আমি মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছি। তারকাখ্যাতি কিংবা উচ্ছ্বাসের চেয়েও সম্মানটা অনেক বড় ব্যাপার। আমি সম্মান নিয়ে কাজ করেছি। এটার হয়তো একটাই কারণ, আমার স্বামী আমাকে সঠিকভাবে গাইড করেছেন। সম্মান আর ভালোবাসা নিয়ে কাজ করেছি। স্বামীর কারণে কোনো অন্ধকার আমাকে ছুঁতে পারেনি।