সুনসান গুলশান সোসাইটি লেক পার্ক। ঠিক বিকেল পৌনে পাঁচটায় পার্কের প্রধান ফটকে নামলেন জেমস। পরনে টি-শার্ট-জিনস। হঠাৎ জেমসকে দেখে পার্কের নিরাপত্তারক্ষীসহ আশপাশের অনেকে অবাক, মুহূর্তেই জটলা। সময় নিলেন না রকস্টার, স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত চাহনিতে ঢুকে পড়লেন পার্কে।
পরিকল্পনা ছিল দিনের আলো থাকতে থাকতে ছবি তোলা হবে। আলোকচিত্রী খালেদ সরকারও প্রস্তুত। জেমসও আন্তরিক। তবে এই গায়কের ক্যামেরার সামনে থাকার চেয়ে, পেছনে থাকাটাই পছন্দ। বেশ কয়েক বছর ধরে ছবি তুলছেন। ফ্রেম দেখে নিচ্ছেন মাঝে মাঝে। একবার তো নিজেই ক্যামেরা হাতে নিয়ে দেখালেন মুনশিয়ানা। আন্তরিকতা নিয়ে সময় দিলেন। ছবি তোলা শেষ। এবার গন্তব্য বনানীর এক হোটেল। গাড়িতেই জমে ওঠে আড্ডা। জেমসকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন ঠিকঠাক মন বসলে আড্ডাটা খুব উপভোগ করেন জেমস।
একসময় রেকর্ডের স্টপ বাটনে চাপ দিই। মাপা উত্তর অনুমেয় হলেও পুরো আলাপে যেন অন্য এক জেমসকে খুঁজে পাই। বললে বাড়াবাড়ি হবে না, স্বল্পভাষী জেমস এদিন যেন হাজির ছিলেন আড্ডাবাজরূপে। তিনি হেসেছেন, মজা করেছেন। পুরোনো কথায় স্মৃতিকাতর হয়েছেন। মায়ের প্রসঙ্গ এলে ছলছল করছিল তাঁর চোখ।
বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। নিশ্চয়ই তিনি চাইতেন পড়াশোনা করে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার হবেন। ব্যান্ডসংগীতে জড়ালেন কীভাবে?
জেমস: তা তো জানি না, কীভাবে জড়িয়ে পড়লাম। সংগীতের সঙ্গে আসলে মানুষ কীভাবে জড়ায়? তখন বাইরের গান প্রচুর শুনতাম। এভাবে ওয়েস্টার্ন গানের সঙ্গে পরিচয় হয়, সংগীতের প্রতি ভালো লাগা জন্মায়। এ ভালো লাগা থেকেই জড়িয়ে পড়া।
প্রথম আলো :
কাদের গান বেশি শুনতেন তখন?
জেমস: অনেক লম্বা তালিকা। ৬০-৭০ দশকের রক ঘরানার সব ব্যান্ডের গানই শোনা হতো। কয়েকজনের কথা বলতে গেলে, জিমি হেনড্রিক্স, ডায়ার স্ট্রেইট, ডিপ পার্পল, পিংক ফ্লয়েডসহ আরও অনেকেই।
প্রথম আলো :
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা অবলম্বনে ‘পুবের হাওয়া’। শামসুর রাহমানের ‘উত্তর’ কবিতা থেকে ‘তারায় তারায়’। কবিতা থেকে সুরের ব্যাপারটা কীভাবে হলো?
জেমস: কবিতা ভালো লাগত, টানত। বইটই পড়া হতো তখন। কিছু কবিতা পড়ে মনে হলো সুর দেওয়া যায়, এভাবেই আরকি।
জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে আমি কখনো গান করিনি। জনপ্রিয়তা যেটা পাওয়ার পেয়েছে, যেটা পায়নি, পায়নি। এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি।
এখনো নিয়মিত কবিতা পড়া হয়? এখনকার কারও লেখা কি ভালো লাগে?
জেমস: না, এখন আর গানও শোনা হয় না, পড়াশোনাও হয় না। গল্প–কবিতা সবকিছু থেকেই দূরে আছি ইদানীং। সময়টা অনলাইনের, এখানে যা আসে, সেগুলোই দেখা হয়।
প্রথম আলো :
বলিউড থেকে ডাক পেলেন। সেখানেও নিজের জানান দিলেন। থাকার প্রস্তাব ফেরালেন কেন?
জেমস: ওদের তখন এমন একটা কণ্ঠের প্রয়োজন ছিল, তাই ডেকেছিল। কাজ শেষ, ব্যস চলে এসেছি। ওই বয়সে কে ওখানে স্ট্রাগল করে? ওখানে ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হতো। একটা স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যেতে হতো না? সেটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই থাকিনি।
প্রথম আলো :
কয়েক প্রজন্ম আপনার গান শুনছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে কনসার্টের প্লে লিস্টেও পরিবর্তন এনেছেন। কখনো কি কোনো গানের ক্ষেত্রে এমন মনে হয়েছে, যতটা জনপ্রিয় হবে বলে আশা করেছিলেন, ততটা হয়নি?
জেমস: জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে আমি কখনো গান করিনি। জনপ্রিয়তা যেটা পাওয়ার পেয়েছে, যেটা পায়নি, পায়নি। এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি।
গায়কি নিয়ে কখনো বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়নি। আমার যখন যেটা মনে হয়েছে, সেটাই করেছি। কে কী ভাবল, ওসব নিয়ে ভাবিনি।
নানা সময়ে গায়কি নিয়েও বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। শুরুর দিকের অ্যালবামগুলোর গায়কির সঙ্গে বর্তমান গায়কি বেশ আলাদা। সময়ের সঙ্গে গায়কির পরিবর্তন নিয়ে কোনো নেতিবাচক কথা শুনেছেন?
জেমস: না, গায়কি নিয়ে কখনো বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়নি। আমার যখন যেটা মনে হয়েছে, সেটাই করেছি। কে কী ভাবল, ওসব নিয়ে ভাবিনি।
প্রথম আলো :
ইদানীং আপনার কনসার্টের প্লে লিস্ট নির্দিষ্ট কিছু গানে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আপনার তো আরও অনেক জনপ্রিয় গান আছে, যেগুলো একসময় কনসার্টে গাইতেন। পুরোনো সে গানগুলো করেন না কেন?
জেমস: নির্দিষ্ট করে এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার প্লে লিস্টের পরিবর্তন এসেছে। সামনেও পরিবর্তন আসবে। তখন হয়তো অন্য গানও করা হবে।
প্রথম আলো :
আপনার শেষ দিককার অ্যালবামগুলোর বেশির ভাগ গান বিশু শিকদারের লেখা। দুই বছর আগে এই গীতিকবি মারা গেছেন। আসিফ ইকবাল, লতিফুল ইসলাম শিবলী, প্রিন্স মাহমুদ, মারজুক রাসেল, দেহলভীসহ অনেকেই আপনার জন্য লিখেছেন।
জেমস: বিশুর মৃত্যুটা আমাকে ভুগিয়েছে। কষ্ট পেয়েছি অনেক। ভালো একজন বন্ধুকে হারিয়েছি। গানের বাইরেও তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। বিশুসহ বাকি সব গীতিকবি অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছে। সবার প্রচেষ্টাতেই তো একটা ভালো গান হয়।
(কথা বলতে বলতে আমরা তারকা হোটেলের নিচে পৌঁছে যাই)
প্রথম আলো :
রাস্তার সস্তা হোটেল থেকে দেশ-বিদেশের দামি রেস্তোরাঁর খাবার চেখে দেখেছেন, মায়ের হাতের কোনো রান্নার স্বাদ কি মনে পড়ে, কোনো ঘ্রাণ কি এখনো পান?
জেমস: তা তো মনে থাকবেই, ভুলে যাওয়ার কিছুই নেই। সব, সবকিছুই—মায়ের হাতের সব খাবার অনেক মিস করি। মায়ের হাতের রান্না তো সবারই ভালো লাগে, এটা তো আর ভুলে যাওয়া যায় না।
প্রথম আলো :
কোথাও একবার বলেছিলেন, একদিন হুট করে এই শহর ছেড়ে চলে যাবেন নিজ গ্রামে। নগরজীবনে কি ‘নগরবাউল’ ক্লান্ত?
জেমস: এখনো খুব ইচ্ছে আছে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার। সব সময় মনে হয় শান্ত কোথাও চলে যাই। নাগরিক এ জীবনের ক্লান্তি বলতে আমার মধ্যে দুই ধরনের বিষয় কাজ করে। এখানে থাকতে বিরক্ত লাগে, আবার দূরে গেলে মিস করি। মানে একটা দোটানা। একবার শহর ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয়, শহর ছেড়ে চলে গেলে মনে হয় এ শহর আমাকে ডাকছে।
প্রথম আলো :
এই শহরেই আপনি থাকেন, কিন্তু থেকেও যেন এই শহরে আপনি নেই। এই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেন, একাকিত্ব কি ভোগায়?
জেমস: কোথায় একাকিত্ব? কখনো এমন অনুভব করিনি। হয়তো আমার সার্কেল অনেক ছোট। তবে আমি যাদের সঙ্গে মিশি, খুব ক্লোজ যারা, তাদের সঙ্গে আমি তো সব সময় আছি।
খ্যাতি, অর্থ—সবই তো পেলেন, আপনার জীবনে অপূর্ণতা আছে?
জেমস: অপূর্ণতা এখনো বোধ করছি না। চাওয়া যদি তোমার বেশি কিছু না থাকে, তাহলে অপূর্ণতা আর কীভাবে গ্রাস করবে? এত চাওয়ার দরকারই তো নেই। আর আমার চাওয়া নেই, অপূর্ণতা আসবে কোত্থেকে!
নাগরিক এ জীবনের ক্লান্তি বলতে আমার মধ্যে দুই ধরনের বিষয় কাজ করে। এখানে থাকতে বিরক্ত লাগে, আবার দূরে গেলে মিস করি। মানে একটা দোটানা।
প্রথম আলো :
চাওয়া-পাওয়ার কথা যখন এল, দেশ-বিদেশের অনেক শিল্পী রাজনীতিতে জড়িয়ে আলোচিত–সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু আপনাকে সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে দেখা গেছে, বিষয়গুলো নিয়ে কখনো কথাও বলতে চাননি। রাজনীতি নিয়ে আপনার জীবনদর্শন কী?
জেমস: আমি একজন শিল্পী, শিল্পীরা রাজনীতিসচেতন হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করি না। আর যদি রাজনীতিই করতে হয়, সব ছেড়ে ফুলটাইম রাজনীতি করা উচিত।
প্রথম আলো :
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব কখনো পেয়েছেন?
জেমস: ও আসেই। জীবনে অনেক এসেছে।
একসময় বনসাইয়ের প্রেমে পড়লেন, কুকুর পোষার প্রতি ভালোবাসা জন্মাল, সবশেষে আমরা দেখলাম ফটোগ্রাফি। এখন অবসর কী নিয়ে কাটান?
জেমস: এখন কোনো কিছুই করছি না। একদম গান নিয়েই আছি, গানের ভেতরই আছি। নতুন গান তৈরি হচ্ছে। ব্যস্ততা এখন এটা নিয়েই। ফটোগ্রাফিসহ অন্য কিছুতে এখন সময় দিতে পারছি না।
প্রথম আলো :
নতুন গান কবে পাচ্ছি?
জেমস: নতুন গান নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। কিছু গানের কাজ চলছে। হঠাৎ করে দেখবে যে গান চলে এসেছে। এরপর থেকে গান আসতেই থাকবে, আসতেই থাকবে। কিছুদিন অপেক্ষা করো।
প্রথম আলো :
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সঙ্গে আপনার সিনেমার গানও বেশ জনপ্রিয়তা পেল, এরপরও কেন এই বিরতি?
জেমস: সিনেমায় যে খুব বেশি গান করেছি, তা কিন্তু না। যেসব কাজ করার মতো মনে হয়েছে, করেছি। আবার অনেক কাজ এলেও করার মতো মনে করিনি। সিনেমায় গান করা আমিই বন্ধ রেখেছিলাম। এখন দেখি, যদি ভালো কিছু আসে, অবশ্যই করব।
আপনার গাড়িতে কি আপনার গান বাজে? নিজের কোন গানগুলো বেশি শোনা হয়। অন্য আর কার গান শোনেন?
জেমস: গাড়িতে আমার গান শোনা হয় না। তবে পুরোনো গানগুলো বেশি শুনি। ’৬০-৭০ দশক, আমাদের সময়েরগুলোই বাজে।
প্রথম আলো :
অনেকের মতে আপনার জীবন একটি সিনেমা। কারও কারও কাছে উপন্যাস। আত্মজীবনী কখনো লেখার বা কাউকে দিয়ে লেখানোর পরিকল্পনা আছে?
জেমস: আত্মজীবনী? একদমই না, নেভার। মাথা খারাপ!
প্রথম আলো :
শুনেছি কৈশোরে সাঁতার কাটতে পছন্দ করতেন। মাঝনদীতেও অনেকবার যাওয়া হয়েছে। এখন তো সেই সুযোগ নেই। ফিটনেস ধরে রাখতে এখন কী করেন?
জেমস: অনেক দিন ধরে কিছু করা হচ্ছে না। ভাবছি, কী করা যায়। দেখি এবার ফিটনেস নিয়ে কিছু করা যায় কি না।
বলছিলেন হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড, বেইলি রোড থেকে মগবাজারের অলিগলিতে একসময় আপনার পদচারণ ছিল, রেকর্ডিং থেকে আড্ডায় সময় কাটত। সময়গুলো কি মিস করেন?
জেমস: মিস তো করি। অনেক আড্ডা, গল্প, রাত জাগার স্মৃতি। সেসব জায়গায় একবার যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুই চিনতে পারছিলাম না। সব পরিবর্তন হয়ে গেছে, সুউচ্চ ভবন, নতুন নতুন মার্কেট—সবখানে। এই জন্য আর ওই দিকে যাই না। স্মৃতিতে যতটা আছে, এটাই থাকুক, এটাই রাখতে চাই।
প্রথম আলো :
বছরজুড়েই কনসার্টের ব্যস্ততা থাকে, সামনে ব্যস্ততা কেমন?
জেমস: দেশে ব্যস্ততা আছে। বেশ কিছু আয়োজন আছে। আর আগামী মাসে সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে দাম্মাম আর জেদ্দায় যাচ্ছি, ২ ও ৯ মে সেখানে গান শোনাব। এরপর লম্বা সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছি, ২০২৫ ট্যুর নিয়ে।