কাঁদতে কাঁদতে পাখি বলেছিল সে আর শুটিং করবে না...

ঈদে ‘জংলি’ সিনেমা দিয়ে ভিন্নভাবে পর্দায় এসেছেন চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ। ঈদের সিনেমাটি ঘিরে টানা ব্যস্ততার পর গত বৃহস্পতিবার যাচ্ছিলেন বিজ্ঞাপনের ডাবিংয়ে। গাড়িতেই ‘জংলি’ ও বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা প্রসঙ্গে বিনোদনের মুখোমুখি হলেন এই নায়ক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল আলম

প্রথম আলো :

ঈদ কেমন কাটল?

সিয়াম আহমেদ: এবার ঈদটা ফিল্ম নিয়েই কাটিয়েছি। টিমকে পুরো সাপোর্ট দিয়েছি। পরিবারের সঙ্গে আলাদা করে সময় কাটানো হয়নি। যেটুকু সময় পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছি, সেটাও সিনেমাকে ঘিরেই। মা–বাবা, আমার স্ত্রী—তাঁদের নিয়ে সিনেমা দেখেছি। তাঁরা কীভাবে সিনেমাটি নিচ্ছেন, সেটা কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছি। এবার সিনেমাকে ঘিরেই ঈদ কেটেছে।

প্রথম আলো :

আপনার মা ও বাবা সিনেমা দেখে কী বলেছেন?

সিয়াম আহমেদ: এই সিনেমায় আমি দীর্ঘ একটা সময় দিয়েছি। সিনেমার জন্য চুল–দাড়ি বড় করেছি। একটা সিনেমার জন্য আমার পাগলামি নিয়ে মা–বাবার মনে হয়তো প্রশ্ন ছিল, ছেলেটি চুল–দাড়ি বড় করে কী করছে? কি করেছি, এটা তো তাঁদের বোঝানো যায় না। তবে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সিনেমাটি মুক্তির পরে গল্পটি তাঁদের টাচ করবে। কারণ, গল্পটিই এমন, এটা প্রথম যদি কাউকে টাচ করে, সেটা একটা সন্তানের মা-বাবাদের। যে কারণেই তাঁদের একসঙ্গে হলে নিয়ে কাছ থেকে অনুভূতি জানার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত মা-বাবার কাছ থেকে সেরা ফিডব্যাক পেয়েছি। বাবা–মেয়ের গল্পটি দেখে তাঁরা ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলেন।

বাবা,স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সিয়াম। ছবি: ফেসবুক

প্রথম আলো :

দীর্ঘ সময় একটা সিনেমা নিয়েই থাকা ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে কি না?

সিয়াম আহমেদ: এগুলো তো আসলে পার্ট অ্যান্ড পার্সেল সিনেমা মেকিংয়ে। অনেক সিনেমা মনে হয় সাড়া ফেলবে, পরে দেখা যায় সেটা কাজ করেনি। হয়তো দর্শকদের সেভাবে ভালো লাগে না। এই সিনেমার ক্ষেত্রে সেটা মাথায় আসেনি। এ ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের গল্পের মতো, গল্প শেষ হলেও একটা রেশ থেকে যায়, ইমোশনালি কানেক্ট করে, তেমন উপাদান ছিল গল্পে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, ভালোভাবে চরিত্রটি তুলে ধরতে পারলে দর্শক এটি গ্রহণ করবে। তা ছাড়া ক্যারিয়ারে সব সিনেমাই ব্যবসা করতে হবে, এমনটা আশা করি না। আমি যে বিশ্বাস থেকে সিনেমা করি, মাঝেমধ্যে সেটা কাজে লাগে, মাঝে আবার বিশ্বাসের অন্য রূপ দেখি। দিন শেষে দর্শকেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথম আলো :

সিনেমাটি দেখে অনেকেই বলছেন, এটা আপনার ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা। আপনার কাছে কী মনে হয়?

সিয়াম আহমেদ: আমি তাঁদের পছন্দমতো পারফর্ম করতে পেরেছি, চরিত্রটি তাঁদের ভালো লাগায় আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এখন আমি আগের সিয়ামকে ছাড়িয়ে যেতে পারছি কি না, সেটা তো দর্শক, সমালোচক, পরিচালকেরা বলবেন। এখানে আমি কী বলব, আপনারা বলেন।

সহশিল্পী বুবলীর সঙ্গে সিয়াম
ছবি: ফেসবুক

প্রথম আলো :

আপনাকে বেশির ভাগ রোমান্টিক গল্পে দেখা যায়, সেখানে ‘জংলি’ একদম আলাদা গল্প ও চরিত্রের...

সিয়াম আহমেদ: আমি এই সিনেমার চিত্রনাট্য পড়েই ভাবনায় ডুবে যাই। এটা রোমান্টিক গল্প না, অ্যাকশন গল্পও না। শুরু থেকেই আমার কাছে মনে হয়েছে, বাবা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প এটি। একটি ছেলের জংলি হয়ে ওঠার গল্প। যেটা পরে আমাকে চরিত্রের মধ্যে নিয়ে যায়।

প্রথম আলো :

বাবা ও মেয়ের গল্প দর্শকদের কাঁদিয়েছে—এই রসায়ন তৈরি হলো কীভাবে?

সিয়াম আহমেদ: আমি ব্যক্তিগত জীবনে বাবা হওয়ার পরে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতাকে চরিত্রে কাজে লাগিয়েছি। সিনেমাটি যদি আরও চার বছর আগে করতাম, তাহলে শিশু চরিত্রের পাখির সঙ্গে এই বোঝাপড়াটা তৈরি হতো না। সব সময় চেষ্টা ছিল, সম্পর্কটা যেন সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু হয়। দর্শকদের কাছে যেন অভিনয় মনে না হয়, সেই পথটা তৈরি করাই ছিল কঠিন। শিশুটির সঙ্গে দিনের পর দিন একসঙ্গে কথা বলে, মেয়ের মতো আদর করে, বিশ্বাস অর্জন করে, অনেক দিন রিহার্সাল করে কাজে নেমেছি। ডিরেক্টর, রাইটার, সহশিল্পী থেকে টিমের সবার অবদানেই রসায়নটা তৈরি করতে পেরেছি। শিশুটিকে বুঝতে সময় লেগেছে।

সিনেমাটির পোস্টার থেকে

প্রথম আলো :

পাখির অভিনয় নিয়ে কী বলবেন?

সিয়াম আহমেদ: এই চরিত্রকে খুঁজতে লেগেছে চার মাস। পরে পাখিকে পেয়েছি। এটা তার প্রথম সিনেমা। অসাধারণ, গড গিফটেড ব্যাপার তার মধ্যে আছে। অভিনয় দেখে সেটাই মনে হয়েছে।

প্রথম আলো :

পাখির সঙ্গে অভিনয়ের কোন দৃশ্য মনে গেঁথে আছে?

সিয়াম আহমেদ: একটি দৃশ্য ছিল, পাখিকে আমি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসি। এটা আমার জন্য অনেক টাচি একটা ব্যাপার ছিল। একটি শিশুকে এভাবে টেনে নিয়ে আসাটা কঠিন কাজ। আবার দৃশ্যটি মেকি নয় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। সেভাবে শুটিং করতে গিয়ে শিশুটি পড়ে যায়। তারপরও তাকে টেনেহিঁচড়েই নিয়ে আসি। এতে পাখি হাতে ও পায়ে ব্যথা পায়। কিছু জায়গায় চামড়াও উঠে যায়। প্রচণ্ড ব্যথায় পাখি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, সে আর শুটিং করবে না। সে পরিচালকসহ টিমের কারও কথাই শুনবে না। পরে এ কথাগুলো শুনলাম। সবশেষে আমি তাকে পাঁচ মিনিট কোলে নিয়ে বসে ছিলাম। পুরো সময় পাখি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। পরে সে নিজেই বলেছে, ‘চলো, শুটিং করি।’ আমিও তাকে বলি আমার ভুল হয়েছে, তুমি ব্যথা পাও সেভাবে আর শুটিং করব না। এই বোঝাপড়া পরে সিনেমার প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

‘জংলি’ সিনেমার দৃশ্য
সিয়ামের সৌজন্যে

প্রথম আলো :

শুনেছিলাম শুটিংয়ে আপনি বেশির ভাগ সময় দৃশ্যধারণ শেষ করেই আলাদা থাকতেন, কেন?

সিয়াম আহমেদ: শুটিংয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। কেউ চিৎকার করছে। কেউ ফোনে কথা বলছে। কেউ হা হা করছে। নানা পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। যে কারণে পরিচালক চেয়েছিলেন আমি সবার কাছ থেকে আলাদা থাকি। ‘জংলি’ চরিত্রে আমাকে যেমন সবকিছু থেকে দূরে একা থাকতে হতো। তেমন আমি চরিত্রের মধ্যে থাকার জন্য একা থাকতাম। শুটিং ইউনিটে কী হচ্ছে, সেগুলো কিছুই জানতাম না। আমি আমার চরিত্র নিয়ে এসে অভিনয় করে আবার একা থাকতাম।

প্রথম আলো :

লুক প্রকাশের পরে আপনার লুক, চরিত্র, গল্প নিয়ে অনেকেই বলেছিলেন, কবির সং কিংবা রণবীর কাপুরদের অনুকরণ করা। অভিনেতা হিসেবে এসব মন্তব্য প্রভাব ফেলে না?

সিয়াম আহমেদ: না, করে না। এবার একদমই করেনি। কারণ, আমি জানতাম, আমি কী করেছি। এটাও জানতাম, সিনেমা দেখার পরে দর্শকেরা বলবেন, আমি কবির সিং বা রণবীরদের কাছ থেকে কিছু ধার করিনি। সেটা দেখছেনই দর্শক। এখন প্রশংসা করছেন, এটাই তো প্রাপ্তি।

সিনেমার লুকে সিয়াম
শিল্পীর সৌজন্যে

প্রথম আলো :

এবার ঈদের আর কোনো সিনেমা দেখা হয়েছে?

সিয়াম আহমেদ: ব্যস্ততায় ঈদের কোনো সিনেমা এখনো দেখা হয়নি। আমিই দেখার পরিকল্পনা করেছিলাম। পরে টিম থেকে ‘বরবাদ’ দেখার কথা হয়েছে। ‘বরবাদ’ দিয়েই ঈদের সিনেমা দেখা শুরু করব। সিনেমাটির টিম আমাদের বিশেষ প্রদর্শনীতে এসে শুভকামনা জানিয়ে গেছে, সিনেমা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এটা বেশ ভালো লেগেছে।

প্রথম আলো :

কখনো কি মনে হয়েছে, ঈদের একাধিক সিনেমার ভিড়ে ‘জংলি’ নিয়ে না এলেও হতো?

সিয়াম আহমেদ: পরে এলেই যে ভালো ব্যবসা হতো, এমনটা ফিল করিনি। প্রতিটা সিনেমা দেখানোর একটা সময় থাকে। আগের বছর কোরবানি ঈদে কমিটমেন্ট করেছিলাম। তখন সেট ভেঙে গেল। কাজ শেষ না হওয়ায় মুক্তি পেল না। কথা দিয়ে কথা না রাখায় খারাপ লেগেছিল। এবার আগেই ভেবেছিলাম, যা–ই হোক ঈদে দর্শকদের সিনেমাটি দেখাব। সিনেমা ভালো হলে দর্শক খুঁজবেই। সেটাই দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছু হলে গিয়েছি। অনেক দর্শক সিনেমা দেখে কথা বলতে পারছিলেন না, কাঁদছিলেন। এমন নানা অভিজ্ঞতায় মনে হয় সিদ্ধান্ত ভালো ছিল।

প্রথম আলো :

ভক্তরা নায়কদের মধ্যে আপনাকে প্রতিযোগিতায় দাঁড় করাতে চান, এটা কীভাবে দেখেন?

সিয়াম আহমেদ: আমাদের জোর করে প্রতিযোগিতায় জড়ানো হয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে আমি নাই। আমি এ কথা আগেও বলেছি। আমি নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাই। যাঁরা আমাদের আগের কাজ দেখেছেন, তাঁরা যেন বলেন, চেষ্টায় আগের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি। সিয়াম আগের চেয়ে ভালো করেছে, এই কথা শুনতে চাই। আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ, দর্শকদের সব সময় নতুন কিছু দিতে চাই।

সিয়াম আহমেদ। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

প্রথম আলো :

ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা ঈদকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে, শিল্পী হিসেবে এটা ভাবায়?

সিয়াম আহমেদ: এটা ভাবায় এবং মনে করিয়ে দেয়, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেই উদ্যোগটা যাঁরা স্টাবলিশ আর্টিস্ট, প্রডিউসার, ডিরেক্টরদের নিতে হবে। তাঁদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসে দেখাতে হবে, সিনেমা ভালো হলে সব সময়ই দর্শক পায়। তাঁদের সাহস দেখেই অন্যরা সাহস পাবেন।

প্রথম আলো :

সিয়াম তো এখন নায়ক হিসেবে পরিচিত, নিজের সিনেমা ঈদ ছাড়া অন্য সময় মুক্তি দিতে চান?

সিয়াম আহমেদ: এর আগেও ঈদ ছাড়া কিন্তু আমার বেশ কিছু সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, এটা সবাই জানেন। কিন্তু কিছু সিনেমার বাজেট থাকে এমন যে ঈদের আয়োজন ছাড়া রিকোভার করা কঠিন। সিনেমা হলের অবস্থা খারাপ, এটা সবাই জানেন। এখন সিনেমা অন্য কোনো উৎসবে আসতেই পারে। এ জন্য প্রপার একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। আমি একা সাহস করলে কিন্তু কিছুই হবে না। লগ্নিকারী, পরিচালক, শিল্পীসহ অন্যদেরও সাহস করতে হবে। আমি প্রস্তুত, এ জন্য একের পর এক সিনেমা মুক্তিতে অন্যদের সাপোর্ট লাগবে। আমাদের দর্শক আছে। ঢালিউডে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

প্রথম আলো :

আগের তুলনায় আপনার সিনেমার সংখ্যা কম। হাতে চিত্রনাট্য কম পাচ্ছেন, নাকি ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?

সিয়াম আহমেদ: আমি নিয়মিত অনেক চিত্রনাট্য পাচ্ছি। নিয়মিত সেসব সিনেমা করলে প্রচুর টাকা কামাতে পারব। ফিন্যান্সিয়ালি জায়গাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দর্শক আমাকে যেভাবে দেখতে চাচ্ছেন, তেমন গল্প পাচ্ছি না। দর্শকদের প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু দিতে চাই। যখন সামগ্রিক চিন্তা করি, তখন ভাবতে হয় আমি কতটা আয় করলাম তার চেয়েও দর্শকদের সামনে কীভাবে আসছি, সেটা মুখ্য। এটা একটা প্যাকেজ। মাঝে একটা–দুইটা গল্প পছন্দ হয়। কিন্তু সেসব টিমের যে অবস্থা, বাজেট সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে ভালো গল্পটা তুলে আনা কঠিন হবে। তখন আমি না করে দিই। আমি চাইছি নিজের মতো করে কাজ করতে। জীবনে অনেক সিনেমা করতে হবে, এমন চিন্তা নাই। আমার মতো করে অল্প কিছু কাজ করে যেতে চাই।