গান তো এর আগে অনেকে গেয়েছেন, ‘সেই এক সময় ছিল’ গানটি কেন আপনার কাছে আলাদা গুরুত্ব পায়?
পান্থ কানাই : ‘সেই এক সময় ছিল’ করোনাকালে গাওয়া গান। ওই সময়ে আমরা একেকজন একেকভাবে বিভিন্ন রকম শিক্ষা পেয়েছি। সময়টা আমরা একেকজন একেকভাবে কাটিয়েছি। কেউ কিছু পেয়েছি, কেউ কিছু হারিয়েছি। নানাভাবে ওই সময়টা আমাদের জীবনের স্মৃতি বহন করে। সেই সময়কে নিয়ে এই গান। লিখেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, যিনি অসাধারণ গীতিকবি, যাঁর অনেকগুলো গান বাংলাদেশের সংগীতজগৎকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি আমার কাছে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন একজন ব্যক্তিত্ব। গানটিতে যিনি সুর করেছেন, তিনি দেশের বিখ্যাত ব্যান্ড রেনেসাঁর ড্রামবাদক। তিনি শুধু ড্রামবাদক নন, একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। এই মানুষটি এমন একজন, আমি ছোটবেলায় যখন চট্টগ্রাম সরকারি হাইস্কুলে পড়ি, তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বাস্কেটবল মাঠে একটা স্টেজ শো দেখতে যাই। তখন তাঁর ড্রামস বাজানো দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। এতটাই মুগ্ধ হই, তাঁর মতো ড্রামস বাজানোর স্বপ্ন দেখি। তখন থেকেই তিনি আমার দৃষ্টিতে ড্রামস বাজানোয় ভগবান সমতুল্য। এই দুই ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে একটি গান ‘সেই এক সময়’। এটির প্রস্তাব যখন পিলু ভাই দিয়েছেন, খুশিতে সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। গানটা শুনে এত ভালো লেগেছে, ঠিক যে রকম স্টাইল আমি চাই, যেই জনরার মিউজিক আমি পছন্দ করি, তাঁরা তো সেই জনরার মিউজিক করেন। সে জন্য গানটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো :
নতুন আরও কোনো গান কি তৈরি আছে, যা সামনে প্রকাশিত হবে?
পান্থ কানাই : আমার কম্পিউটারে ৩০টির বেশি গান অর্ধসমাপ্ত হয়ে আছে। সব কটি গান আমার নিজের সুর ও সংগীতে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, গানগুলো কোথা থেকে বের হবে। আমার ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম, নাকি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান। একরকম সিদ্ধন্তহীনতায় আছি। পান্থ কানাই অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে ভবিষ্যতে বের করতে পারি। কয়েক দিনের মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনটা গান আসবে। রেকর্ডিং ও ভিডিও শুটিং শেষ।
কোক স্টুডিওতে ‘নাসেক নাসেক’-এর পর আপনাকে আর দেখা যায়নি, কারণ কী?
পান্থ কানাই : ‘নাসেক নাসেক’ গানটিতে আমি অনিমেষের সঙ্গে গেয়েছি। কোক স্টুডিওতে গানটি গাইতে পেরে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি শাওন ভাই, অর্ণবের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। কারণ, তাঁরা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। সাড়াও জুগিয়েছিল গানটি। আমি তো একাই শিল্পী না বাংলাদেশে, আমার চেয়ে অনেক ভালো ভালো, গুণী শিল্পী আছেন, তাঁরা একে একে গাইছেন। যাঁরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাঁরা নিচ্ছেন। এর মধ্যে আরও দুটি সিজন শেষ হচ্ছে। কোক স্টুডিওতে গাইবার স্বপ্ন, ইচ্ছা সবারই আছে। আবার যখন আমাকে ডাকা হবে, তখন গাইব। প্রথম সিজনের পর আমাকে ডাকা হয়নি বলে শ্রোতারা আমাকে পায়নি।
প্রথম আলো :
শিল্পীজীবনে কখন সবচেয়ে একা মনে হয়েছে?
পান্থ কানাই : এটা আমার কাছে খুবই জটিল প্রশ্ন। সংগীতাঙ্গনে আমার শুরুটা হয়েছে ড্রামসবাদক হিসেবে। গাওয়া শুরু করেছি ২০০১ সালে। বাংলাদেশের কয়েকটা লিজেন্ডারি ব্যান্ডে ড্রামস বাজিয়েছি। এর মধ্যে সোলস, নগরবাউল অন্যতম। সোলসে ৬-৭ বছর বাজিয়েছি। ১৯৯৮ সালে জেমস ভাইয়ের সাথে নগরবাউল ব্যান্ড গঠন করি। আমি সোলস থেকে বেরিয়েছিলাম আর জেমস ভাই, আসাদ, বাবু ফিলিংস থেকে—সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নগরবাউল গঠন করব। দুই বছর ব্যান্ডটা করি। ২০০০ সালের শেষের দিকে কোনো একটা অদৃশ্য কারণে বা বিশেষ কারণে নগরবাউল থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। আমার বাড়ি চট্টগ্রামে, থাকতাম ঢাকায়। ওই সময়ে খুব একা লেগেছিল। নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলাম। নগরবাউল থেকে বের হয়ে আমি কি মিউজিক কন্টিনিউ করব, ড্রাম বাজাব নাকি অন্য কিছু? কী করে ঢাকায় সারভাইব করব? তখন আমি তরুণ, ওই সময়ে খুব একা একা অনুভব করেছিলাম। একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করেছিল। তবে সেই হতাশা বেশি দিন থাকেনি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, আর ড্রাম বাজাব না। আমি গান গাইব। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন সংগীতার কর্ণধার সেলিম খান। তিনি আমাকে প্রথম এককভাবে সুযোগ দেন। আমার চারটা গান তৈরি ছিল। গানগুলো কোনো মিক্সড অ্যালবামে প্রকাশের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু শোনার পর বললেন, একক অ্যালবাম প্রকাশ করবেন। আমি ‘তাণ্ডব’ নামে ব্যান্ড গঠন করি। সেই ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘মা’ প্রকাশিত হয়।
নিজের গান বা সৃষ্টির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, এমন সময় কি জীবনে এসেছে?
পান্থ কানাই : আমার এত বছরের জীবনে কখনো কোনো চাকরি, ব্যবসা—কিছুই করিনি গানবাজনা ও সৃজনশীলতা ছাড়া। গানবাজনার ওপর আস্থা কখনো হারিয়ে ফেলিনি, এটা ছিল, আছে এবং থাকবে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই শক্তিতে বলীয়ান থাকব। এই জীবনে গানবাজনার জন্য এই ঢাকা শহরে অনেক কষ্ট করেছি। এমনও দিন গিয়েছে, অনাহারে ছিলাম, অর্ধাহারে ছিলাম, কিন্তু গান ছাড়িনি। এটার প্রতি আস্থা খুব গভীর।
প্রথম আলো :
এখন আপনি নিজের জীবনের কোন অধ্যায়ে আছেন—নতুন কিছুর খোঁজে, বিরতিতে, না পুনর্জন্মের পথে?
পান্থ কানাই : আমি সব সময় অধ্যায়ে আছি। যদিও জীবনটা যদি চারটা বিস্কিট হয়, তিনটা আমি খেয়ে ফেলেছি, একটা হাতে আছে। তবে আমি সব সময় নতুন কিছুর খোঁজে থাকি। বিরতি আমার ভাগ্যে নেই। পুনর্জন্মের পথে আমি বিশ্বাস করি না।
আপনি লেখালেখিও করেন। লেখার সময় কোন অনুভূতিটা বেশি কাজ করে—আনন্দ, যন্ত্রণা, না স্মৃতি? আপনার লেখা কি কখনো আত্মচিকিৎসার মতো কাজ করে?
পান্থ কানাই : লেখালেখি করি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা খুবই সীমিত। এ জন্য লেখালেখি করতে ভয় ভয় লাগে। আমাদের জীবন তো আনন্দ, বেদনা, স্মৃতি নিয়ে ভরা। এর বাইরে আমিও নই। এর মধ্যে দ্রোহ বিদ্যমান, যা আমার লেখায় ফুটে ওঠে। লেখালেখি একপ্রকার আত্মচিকিৎসা দেয় বৈকি। লেখার মধ্যে আমি একধরনের আনন্দ পাই, যেটা আমার আত্মাকে চিকিৎসা করে, এটাও ঠিক। লেখাটা আমার ওষুধের মতো কাজ করে।
আপনার ড্রামস শেখানোর স্কুলটি বন্ধ, এর পেছনের গল্পটা কী? এই বন্ধের কারণে আপনার মানসিক অবস্থায় কী প্রভাব পড়েছে?
পান্থ কানাই : শিশুদের জন্য সংগীতশিক্ষা একটা অপরিহার্য ব্যাপার। এতে শিশুদের নানাবিদ উপকার ছাড়া কোনো অপকার নেই। এ নিয়ে বেশ কয়েকটা আর্টিকেল আমার ফেসবুক পেজে লিখেছি। সেই তাগিদে ২০১৮ সালে ‘ড্রামবাজ’ নামের একটা স্কুল চালু করেছিলাম। দুই বছর কার্যক্রম চালিয়েছি। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে যে যার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এরপর গান আর স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এ ছাড়া আমার কিছু অসুবিধাও ছিল। ড্রামবাজ বন্ধের পর ভালো জায়গাও পাচ্ছিলাম না, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা আসবে। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা আছে, মনমতো জায়গাটা পেলে ড্রামবাজ স্কুল বড় পরিসরে শুরু করব। ড্রামস, গিটার, গান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখাব।
আপনার জীবনে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কোথা থেকে আসে?
পান্থ কানাই : প্রশ্নটা খুবই সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ। আসলে একজন শিল্পীর জীবনে শিল্পকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণাটা অনেক জায়গা থেকে আসে। আমি মনে করি, এর মধ্যে প্রধান প্রেরণা হচ্ছে অন্তরের ডাক। বলতে গেলে, মনের গভীর অনুভূতি থেকে এই প্রেরণা আসে। শিল্পীরা নিজের জীবনের দুঃখ, অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের জন্য শিল্পকর্মে ডুবে থাকে। এই শিল্পকর্ম কিন্তু আত্মপ্রকাশের একটা চমৎকার পথ। এরপর প্রেরণা আসে সমাজ ও মানুষ থেকে। আমরা যে সমাজে থাকি, সে সমাজের নানাবিধ ঘটনা, মানুষের হাসি-কান্না, অন্যায়-অবিচার—এখান থেকেও প্রেরণা পাওয়া যায়। হঠাৎ হঠাৎ একটা দ্রোহ-বিদ্রোহের ডাক আসে, যেটা শিল্পীদের বিভিন্নভাবে নাড়া দেয়, অনুপ্রাণিতও করে। এই যে আমাদের প্রকৃতি, প্রকৃতির সৌন্দর্য, এই যে আমাদের নদী-নালা, ঝড়-বৃষ্টি, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত এই সব দৃশ্য, পাখির ডাক—এগুলো আমরা যারা শিল্পীরা আছি, তাদের মনে সুর এনে দেয়। আমাদের যে শিল্পীমনের ভাবনা, এটা আসে এই প্রকৃতি ও সৌন্দর্য থেকেই। এর বাইরে এক ধরনের অন্তরের তৃষ্ণা তো আছেই। যাঁরা সত্যিকারের শিল্পী, তাঁদের নিজের মনের একটা তাগিদ থাকে। সেই তাগিদ থেকে তাঁরা সুর সৃষ্টি করেন। সেই সুর থেকে তাঁরা একধরনের শান্তি পান। সব সময় তাঁরা শান্তি খোঁজেন, যেটা সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্তার অবদান। আবার আমাদের যে মা-বাবা, শিক্ষাগুরু ও পূর্বসূরিরা যে আছেন, তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে, তাঁরা যে শিক্ষা দিয়েছেন, সে পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া একটা প্রেরণা মনে করি।
প্রথম আলো :
আপনি কি এখনো নিজের ‘সবচেয়ে ভালো গানটা’ গেয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন, নাকি সেটা এখনো বাকি?
পান্থ কানাই : একজন শিল্পী কখনো সন্তুষ্ট হতে পারে না, ঠিক তেমনই আমিও সেই গান এখনো গাইতে পারিনি, যে গানটি আমি খুঁজছি। গাইতে চাই। গানটি যদি আমার গাওয়া হয়ে যায়, তখন তো আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমি এখনো অতৃপ্ত। জানি না, আদৌ তৃপ্তি আসবে কি না মৃত্যুর আগপর্যন্ত। আমার মনে হয়, আমি অতৃপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করব। সেই কারণেই হয়তো গুণীজনেরা বলেছেন, শিল্পীরা কখনো তৃপ্ত হতে পারেন না, তাঁদের আত্মা সব সময় অতৃপ্ত থেকে যায়।
স্টেজ শোর ব্যস্ততা কেমন? এখনো যখন মঞ্চে দাঁড়ান, রোমাঞ্চ অনুভব করেন, নাকি পেশাগত দায়িত্ব?
পান্থ কানাই : বিগত এক বছর যাবৎ স্টেজ শো নেই বললেই চলে। সুতরাং স্টেজ শোর ব্যস্ততা একেবারে নেই। সেটার কারণ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। আমি একজন পেশাদার শিল্পী, এটা সত্যি কথা। এটা করে আমার পরিবার চলে। তাদের মুখে অন্ন জোগাই। আমি যখন স্টেজে উঠি, গানবাজনা করি, তখন আমার একমাত্র চাওয়া থাকে, পাওয়া থাকে, যেটা আমি পেতে চাই—আমার শ্রোতাদের ভালোবাসা। শ্রোতারা যে ভালোবাসে, সেটাই আমার প্রধান শক্তি। সেই শক্তিতে গানবাজনা করি। পেশাদার হয়েও রোমাঞ্চ অনুভব করি। আমি আসলে যখন গান গাই, ঈশ্বর ও শ্রোতাদের ওপর শতভাগ সমর্পণ করে গান গাই। আমার শ্রোতারাই আমার একমাত্র শক্তি। তাঁদের জন্যই আমার জীবন, তাঁদের জন্যই আমার সমস্ত সৃষ্টি, তাঁদের জন্যই আমার গান গাওয়া।