‘দাগি’ হিট হওয়ার পাঁচ কারণ জানালেন পরিচালক

প্রেক্ষাগৃহে চলছে শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘দাগি’ ছবি। দেশের যে কয়টি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রদর্শিত হচ্ছে, সব জায়গায় হাউসফুল যাচ্ছে। ছবিটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ এমনটা হবে কি ভেবেছিলেন, কী কী কারণে দর্শকের আগ্রহ, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন পরিচালক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

মুক্তির ১৯ দিন চলছে, এখনো ‘দাগি’ ছবিটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ বেশ লক্ষণীয়। যেসব প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে, সব জায়গায় টিকিট পাওয়া নিয়ে সংকটের খবরও শোনা যাচ্ছে। মুক্তির আগে ছবিটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ এমনটা হবে, ভেবেছিলেন?

সাফল্যের ব্যাপারে একটা আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল। আমি যে ধরনের সিনেমা বানাই, বরাবরই দর্শককে আটকে রাখতে চাই। দর্শক আটকে রাখতে না পারলে আমার মনে হয়, ব্যর্থ হয়ে গেলাম। ছবির শুটিং শুরুর আগে মনে হতো, দর্শককে একটু একাত্ম করতে হবে, তাই নিজেও গল্পের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করতাম। যেকোনো কনটেন্টের সঙ্গে আমি যখন একাত্ম হই, তখন একটা বিশ্বাস জন্মে। এতকাল ধরে কাজ করে এটা মনে হয়েছে, নিজে একাত্ম হতে পারলে দর্শকেরও তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজও করিনি। আমাদের সিনেমার সঙ্গে যায় না, এমন কিছু গল্পে রাখিনি। ছিল না কোনো আইটেম গান। নিশান (আফরান নিশো) চরিত্রের গল্পের যে ভ্রমণ, তার সঙ্গে যদি আইটেম গান রাখা হয়, তাহলে গল্পের মূল মেজাজটা হারাত। অন্য একটা গল্প মনে হতো। জোর করে আরোপিত মনে হতো। কিন্তু একটা বিশ্বাস ছিল, দর্শক একাত্ম বোধ করবে। আমরা যে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছি, করছি—সেটা টিমের সবাই নিশ্চিত ছিলাম। একজন আসামির প্রায়শ্চিত্তের গল্প নিয়ে ছবি হয়নি, এটা নিশ্চিত ছিলাম; তাই এ বিষয়ে ঠিকঠাকভাবে কিছু দিলেই দর্শক গ্রহণ করবে। তবে ঝুঁকিও ছিল, কারণ, নতুন কোনো ভাবনায় সহজে দর্শক একাত্ম হবে কি না। প্রত্যাশা ছিল, বিশ্বাস ছিল দর্শককে একাত্ম করে গল্পটা বলা হবে, গল্পে জোর থাকবে—আমার বিশ্বাস ছিল, মানুষও গ্রহণ করবে, হয়েছেও তা-ই।

শিহাব শাহীন
ছবি : প্রথম আলো
প্রথম আলো:

দর্শকের আগ্রহ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা মত দিচ্ছেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে ছবি হিটের জন্য কেউ ১০টি, কেউবা ৭টি কারণ দাঁড় করাচ্ছেন। আপনার দৃষ্টিতে কোন ৫টি কারণে ছবিটি নিয়ে দর্শকের এতটা আগ্রহ? সেই কারণগুলো একটু বিস্তারিত যদি বলতেন।

এই ছবির দর্শক আগ্রহে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সেখান থেকে আমি পাঁচটি বলার চেষ্টা করছি। তবে টিমের প্রত্যেক মানুষের অবদান কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এত সবকিছুর পাঁচ কারণের প্রথমটি হচ্ছে, গল্পে নতুনত্ব ছিল। প্রথম থেকে আমি বলেছি, ‘দাগি’ গল্পের সিনেমা হবে। নিশো দুই বছর পর, আমি ১০ বছর পর সিনেমা নিয়ে আসছি—আমাদের দুজনেরই চাওয়া ছিল গল্পকে হিরো বানাতে হবে। হয়েছেও তা-ই। নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো আপস করিনি। অহেতুক দর্শককে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করিনি। গল্পের প্রতি সততা ছিল। প্রায়শ্চিত্তের গল্প নিয়ে আমাদের এখানে ছবি হয়নি, একটা মানুষের ক্ষমা পাওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। এটা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি। ক্ষমা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মানবজীবনে, ধর্মে। নিশানের ক্ষমা, প্রায়শ্চিত্তের জার্নিটা রাখব। বাবা-মেয়ের গল্প, প্রেমের গল্পের চেয়ে আরও মেলোড্রামাটিক কিছু করতে পারতাম। সারা জীবন তো প্রেম নিয়ে কাজ করেছি। আমি প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপারটা রাখতে চেয়েছি। গল্প বলা, গল্পে নতুনভাবে আনা বড় কারণ সাফল্যের।

সাফল্যের দ্বিতীয় কারণ নিশো। নির্মাতা হিসেবে অনেকে আমাকে এক নম্বরে রেখেছে, অনেকে নিশোকেও রেখেছে। আমি বলব, এই ছবিতে নিশো একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। তাঁর ভক্তরা ছবির জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করছিল। নিশোও প্রস্তুত হচ্ছিল। ছবিতে যে অভিনয় দরকার ছিল, নিশান চরিত্রটি হওয়ার জন্য—আমি বলব, নিশো এই ছবিতে তা প্রমাণ করেছে দারুণভাবে। আসলে মেথড অ্যাক্টররা ইমোশনালি অনেক বেশি সম্পৃক্ত থাকে। যখন প্রয়োজন ছিল, সহজাত অভিনয়ও করেছে নিশো। তাই বলা যেতে পারে নিশোর নিষ্ঠা, পরিশ্রমের কারণে দুর্দান্ত অভিনয়ে রূপ নিয়েছে। মানুষ তা প্রতিমুহূর্তে দেখেছে। তার অভিব্যক্তি পর্দায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যখন সে আসলেই নিশান হয়ে উঠেছিল।

তৃতীয়ত, অন্যদের অভিনয়। জেরিন (তমা মির্জা) চরিত্রটাও দারুণ ছিল। আমাদের সংশয় ছিল, একটা কিশোরী মেয়ের মা হিসেবে জেরিন কতটা কী করতে পারে। কিন্তু সে আমাদের চাওয়ার চেয়ে ভালো করেছে। সব সময় তাঁকে রিহার্সাল করিয়েছি। ব্যক্তিজীবনে কেউ মা না হলে সঠিকভাবে মায়ের চরিত্রের সার্থক রূপায়ণ করাটা কঠিন হয়। কিন্তু তমার একটা বিড়াল ছিল, সেটাকে আমরা সন্তান ভাবতে শিখিয়েছি। অন্যদের মধ্যে লিখন, সুনেরাহসহ অনেকে সহজাত অভিনয় করেছে। সবকিছু বাস্তব মনে হয়েছে। বাবা চরিত্রে গাজী রাকায়েত তো দারুণ করেছেন। নিশোর অভিনয়ে অভিষেক হয়েছিল গাজী রাকায়েতের নাটকে; তিনি সব সময় ফাদার ফিগার ছিলেন। আমাদের রাশেদ মামুন অপুও দারুণ করেছে, সে একটা ব্রিলিয়ান্ট রোল প্লে করেছে। সে রঞ্জিত সরকারের (শহীদুজ্জামান সেলিম) মতো হিংস্র নয়, কিন্তু তার মধ্যে রাজনীতিবিদদের মতো ধূর্ততা, দ্বৈত সত্তা, ব্যক্তিগতভাবে নিচু মানসিকতার ব্যাপারগুলো ধারণ করেছে চমৎকারভাবে। আর রঞ্জিত সিং চরিত্রে সেলিম ভাইয়ের জন্য হিন্দি ভাষায় কথা বলা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তবে বলে বলে রপ্ত করেছেন। প্রত্যেকে খুবই বাস্তবসম্মত অভিনয় করেছে। সবার বাস্তবসম্মত অভিনয়ের কারণে গল্পটা বেরিয়ে এসেছে।

চতুর্থ কারণ, আমাদের প্রোডাকশন ডিজাইন। বাংলাদেশে প্রোডাকশন ডিজাইন নিয়ে কাজ খুবই হয় কম। কিন্তু আমাদের প্রি-প্রোডাকশন খুব ভালো হয়েছিল। প্রোডাকশন ডিজাইন পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এটাই করব, এভাবেই দেখাতে চাই, সেটাই করেছি। হঠাৎ কোনো কিছুর ইম্প্রোভাইজেশনের দরকার যেন না পড়ে, সেটাও আমরা ঠিক করেছি। সিনেমাটোগ্রাফি তো দারুণ হয়েছে। আমাদের কস্টিউম, মেকআপ থেকে শুরু করে প্রত্যেক সহকারী সিনসিয়ারলি কাজ করেছে, দিনরাত পরিশ্রম করেছে। এতে করে প্রোডাকশন ভ্যালুটা বেড়েছে। বাজেট সীমাবদ্ধতার বিষয়টা বুঝতে পারেনি।

পঞ্চম কারণ, আবহসংগীত। সাজিদ সরকার ‘দাগি’ ছবির আবহসংগীত করেছে। এই প্রথম আমরা শুটিংয়ের আগে একটা থিম ট্র্যাক রেডি করেছিলাম, যেটা সব সময় শুটিংয়ে কাজে দিয়েছি। বড় বড় প্রোডাকশনে থিম স্কোর, থিম মিউজিক থাকে, যেটার আলোকে সিনেমাকে সাজানো হয়। একেক জায়গায় একেক সুর বাজবে, তা নয়। যেখানে ড্রামার মিউজিক দরকার সেখানে তা; যেখানে সাসপেন্সের, সেখানে তা; রোমান্স-কমেডি পুরোটা মিলিয়ে একই ঘোরের মধ্যে রাখা। সাজিদের আবহসংগীত দুর্দান্ত। তাই এটাও একটা বড় ফ্যাক্টর।

আরও পড়ুন
‘দাগি’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তমা মির্জা ও আফরান নিশো।
ছবি: ফেসবুক
প্রথম আলো:

‘দাগি’ ছাড়া ঈদের আর কোন ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে?

এখনো দেখার সুযোগ পাইনি। মুক্তির প্রথম দিন থেকে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। খুব শিগগির দেখে ফেলব।

প্রথম আলো:

শুধু ঈদের আলোচিত বা হিট ছবিগুলো মুক্তি পাচ্ছে। অন্যদিক থেকে দেখলে শুধু ঈদের ছবিগুলোই ব্যবসাসফল হচ্ছে বা আলোচনায় আসছে...

আমি মনে করি, সারা বছর বড় বড় ছবি বানাতে হবে। ভালো ছবি বানাতে হবে। দেখা যায় যে ঈদের সময় বেশি বাজেট ও স্টার কাস্ট নিয়ে বড় ছবি বানানো হয়। অন্য সময় দর্শকের চাহিদা থাকলেও ছোট স্কেলে ছবি বানানো হয়। আমি বলব, অন্য সময়টাকেও ঈদের মতো উৎসব ভেবে বড় ছবি বানাতে হবে। ঈদ উৎসবের মতো না হলেও একটা মিনিমাম প্রোডাকশন খরচ রেখে স্টারদের দিয়ে ছবি বানাতে হবে। শাকিব খান তো দুই ঈদে দুটো ছবি করছেন, তিনি যদি বছরে চারটা করেন তাহলে ভালো। এদিকে নিশো বলেছে, সে তিনটা করবে। বছরব্যাপী এ রকম বেশ কয়েকটা ছবি যদি হয়, তাহলে চিত্র বদলাবে।

আরও পড়ুন