দর্শকই আমার প্রাণশক্তি: হানিফ সংকেত

দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এবং দীর্ঘ ৩৬ বছর ইত্যাদি চলছে সমানতালে। কারণ এর গ্রন্থনা, পরিকল্পনা এবং পরিচালনা যাঁর হাত ধরে, তিনি একজনই হানিফ সংকেত। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল হক

প্রথম আলো:

আপনি ‘ইত্যাদি’ করছেন সুদীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে! বাংলাদেশে আমাদের একটা প্রবণতা হলো ধারাবাহিকতার অভাব। আমরা কোনো কাজে দীর্ঘদিন লেগে থাকতে পারি না। আপনার এই ধারাবাহিকতার রহস্য কী?

হানিফ সংকেত: আগে একটা নিয়ম ছিল, কোনো অনুষ্ঠানে বিরতি পড়ে গেলে তা আর করতে দেওয়া হতো না। ইত্যাদিতে যেন বিরতি না পড়ে, সে জন্য আমি বহুদিন বিদেশে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছি। আর আমি ইত্যাদি দর্শকদের মধ্যে বসে নিজে দেখতাম। এর ফলে মানুষের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ স্থাপিত হতো। মানুষ বলত, আপনি কখনো বন্ধ করবেন না। চালিয়ে যান। বয়স্করা দোয়া করতেন। আমি এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু সামাজিক কাজ করা শুরু করলাম। যুবসমাজ বিভিন্ন জায়গায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল। যেমন রাজশাহীতে ১১ জন বলে একটা অনুষ্ঠান করলাম। ওরা ১১১ জন হয়ে গেল। এই যে ভালো কাজের হোটেল। এরা তো ছোট করে শুরু করে। আরিফ আর নাজমুল দুজন। রাস্তায় টাকা তোলে। ঈদের সময় শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে গিয়ে দেখি, তারা বসে আছে কাচের বাক্স নিয়ে। আমিও কিছু টাকা দিলাম। তাদের কাছে জানতে চাইলাম বিশদভাবে। তারা আমার সঙ্গে দেখা করল। বুঝলাম, এদের কাজের স্বচ্ছতা আছে। ওরা শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। আমি ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখলাম, ঘটনা সত্য। শুধু চিকিৎসা করে না, গ্রামে গিয়ে শিশুদের আবার খোঁজ রাখে। আমি এদের নিয়ে প্রতিবেদন করলাম। আজ তাদেরই একজন আরিফের ‘ভালো কাজের হোটেল’ অনেক বড় হয়ে গেছে। পুরস্কার পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। পলান সরকারের কথা জাতিকে ইত্যাদিই প্রথম জানায়। তিনি একুশে পদক পান। গহের আলী ১০ হাজার তালগাছ লাগিয়েছেন। আমি প্রতিবেদন করলাম। তিনি প্রথম পরিবেশ পদক পেলেন। এখন কয়েক লাখ তালগাছ তিনি লাগিয়েছেন। ইত্যাদিতে প্রচার করা গ্রিন সেভার্সের রনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, এ বছর পাচ্ছেন জাতীয় পরিবেশ পদক। এমনই আরও অনেকেই রয়েছেন, ইত্যাদিতে যাঁদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে, তাঁরা জনকল্যাণ ও মানবিক কাজে নিয়োজিত আছেন এবং মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

তাহলে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে অবদান রাখা থেকেই আপনি অনুপ্রেরণা পান?

হানিফ সংকেত: হ্যাঁ। অনুষ্ঠান মানে শুধু আনন্দ–বিনোদন, গানবাজনা নয়। তবে আমরা চেষ্টা করি বিনোদনের মাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা দিতে। কারণ, গম্ভীর কথা বলার লোক এই দেশে অনেক আছেন। আমি আর এই দিকে না যাই। আমরা গল্পের মাধ্যমে, বিনোদনের মাধ্যমে, গান বলি ফান বলি, তার মাধ্যমে একটা মেসেজ দিতে চেষ্টা করি। তবে লক্ষ রাখি, সেটা যেন বক্তৃতা হয়ে না যায়। কারণ, মানুষ আজকালকার বক্তৃতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। যেমন ধরুন, আমি সারা বছরে টেলিভিশন পর্দায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কথা বলি। তারপরও দেখি, দর্শকের চোখে ইত্যাদি সেরা অনুষ্ঠান।

আর এই দীর্ঘ যাত্রা সম্ভব হয়েছে আমরা সময়ের সঙ্গে চলছি বলে। সময়টাকে ধরে রাখতে হয়। কারণ, এখন ডিজিটাল যুগ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগ। সুতরাং শুধু ইত্যাদিই নয়, প্রতিটি অনুষ্ঠানকেই সময়োপযোগী হতে হবে। তাই বলে ভাইরাল সংস্কৃতি নয়। আমি এই শব্দটাকে পছন্দ করি না। আমি বলি ভাইরাস। ঈদে প্রচারিত ইত্যাদির একটি গান ‘রঙিলা’ এখন বেশ ছড়িয়েছে। কেউ যখন বলে এটা ভাইরাল হয়েছে, আমি খুশি হই না। কিন্তু যখন শুনি এই গানটা সব শ্রেণির দর্শক–শ্রোতা শুনছে, পছন্দ করেছে, তখন খুব ভালো লাগে।

হানিফ সংকেত। ছবি: ফাগুন অডিও ভিশনের সৌজন্যে

প্রথম আলো :

ছোটবেলায় কী ভাবতেন, বড় হয়ে কী হবেন?

হানিফ সংকেত: ছোটবেলায় লিখতাম। ছড়া, কবিতা, গল্প। ঠিক কী হতে চাইতাম, তা নিয়ে ভাবিনি। তবে লিখতে ভালোবাসতাম। তারপর ঢাকায় চলে এলাম। একসময় বিখ্যাত উপস্থাপক ফজলে লোহানীর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে ক্যানটিনে দেখা হতো। গল্প করতেন। ১৯৮১-৮২ সালের কথা। তিনি বললেন, আমার অনুষ্ঠানের জন্য লিখুন। আমি লিখতে শুরু করলাম। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও সমস্যা নিয়ে নতুন ধারায় এক থেকে দুই মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য নাট্যাংশ রচনা শুরু করলাম, যা মানুষকে সামাজিক সচেতনতায় উদ্ধুদ্ধ করত। যা আগে আর হয়নি। একসময় তিনি আমাকে ক্যামেরার সামনে আসতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তাঁর অনুরোধ একসময় দর্শকের অনুরোধ হয়ে গেল। যে কারণ আমাকে অনুষ্ঠানে কিছুটা নিয়মিত হতে হলো।

প্রথম আলো :

প্রথম একক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপন কবে করলেন?

হানিফ সংকেত: ঝলক। ১৯৮৫ সালে ফজলে লোহানী মারা গেলেন। তারপর। তিনি বেঁচে থাকাকালে কর্তৃপক্ষের অনুরোধ সত্ত্বেও আমি কখনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করিনি। তিনি মারা যান অক্টোবরে, আমি প্রথম অনুষ্ঠান করলাম ডিসেম্বরে। ছয় মাস করার পর আমি বিদেশে গেলাম উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে। ছেদ পড়ে গেল। আর ছেদ পড়ে গেলে টেলিভিশনে আগের অনুষ্ঠান করা যায় না। নতুন নামে, নতুন আঙ্গিকে অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়। ফিরে এসে শুরু করলাম ‘কথার কথা’। ১৯৮৭ সালে দর্শকদের অনুরোধে প্রথম ‘কথার কথা’র উপস্থাপক হিসেবে এলাম। বলতে পারেন পাবলিক ডিমান্ডে। কিছুদিন পর আবার গেলাম বিদেশে। লং কোর্সে স্যাটেলাইট ইমেজ নিয়ে। একটা লম্বা সময় থাকার কারণে সেখানে চাকরির প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও থাকিনি। দেশের টানে চলে এলাম।

প্রথম আলো:

প্রথম ইত্যাদি কবে করলেন?

হানিফ সংকেত: ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে বিটিভির প্রযোজনা।

হানিফ সংকেত। ছবি: ফাগুন অডিও ভিশনের সৌজন্যে

প্রথম আলো :

প্রথম বেসরকারি প্রযোজনা ইত্যাদি কবে প্রচারিত হলো?

হানিফ সংকেত: ১৯৯৪ সালের ২৫ নভেম্বর। ইত্যাদি ছিল বিটিভিতে প্রচারিত প্যাকেজ অনুষ্ঠান হিসেবে বেসরকারিভাবে নির্মিত প্রথম অনুষ্ঠান।

প্রথম আলো :

এত দিন ধরে ইত্যাদি হচ্ছে। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী স্মৃতি কোনটা?

হানিফ সংকেত: আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কিশোরগঞ্জের হাওরের পানির ওপর ভাসমান একটি স্কুলের কথা। সেখানে যাতায়াতব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্গম। স্কুল ভবনটিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না। শ্রেণিকক্ষগুলোও ছিল বসার অনুপযোগী। আমরা ইত্যাদির পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন করি এবং যাতায়াতের জন্য বড় নৌকা, বিদ্যুৎ–সংযোগ স্থাপনসহ ভবনটির সংস্কারকাজ করি। যে স্কুলে শিশুরা একসময় ঝুঁকি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্কুলে যেত, তারাই এখন সুন্দর পরিবেশে আনন্দের সঙ্গে গান গাইতে গাইতে স্কুলে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আমি যখন ওই স্কুলে গেলাম, তখন যেন পুরো স্কুল আমাকে জড়িয়ে ধরল। একটা অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হলো। সেই অভিজ্ঞতা অন্তর দিয়ে বুঝতে হবে। ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

প্রথম আলো:

আপনি বলেন, আপনার এই যাত্রা দীর্ঘ। দীর্ঘদিন ধরে ১ নম্বর জায়গাটা ধরে রাখার রহস্য কী?

হানিফ সংকেত: রহস্য কিছুই নয়। আমার নিষ্ঠা, আমার আন্তরিকতা, অনুষ্ঠানের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং দায়বোধ।

প্রথম আলো :

নতুন প্রজন্মের জন্য তিনটি উপদেশ দিন...

হানিফ সংকেত: প্রথমে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে কী করতে চায়, কী হতে চায়। তারপর তাকে পরিশ্রম করে যেতে হবে।

প্রথম আলো :

আমরা দেখি যে আপনি একটি অনুষ্ঠানকে সবচেয়ে সুন্দর করার জন্য খুব পরিশ্রম করেন। একবিন্দু ছাড় দেন না...

হানিফ সংকেত: ছাড় দিলে তো ৩৬ বছর চালাতে পারতাম না। দর্শকই আমার প্রাণশক্তি। তাদের অনুপ্রেরণায় আজও চালিয়ে যাচ্ছি। আরেকটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্যতা ও সততা। আপনি যদি সৎ না হন, আপনি যত কিছুই করেন না কেন, একসময় থেমে যাবেন, আপনি এগোতে পারবেন না। একসময় না একসময় আপনি লিক করবেন। কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা থাকতে হবে। শিল্পকর্মে ব্যবসা প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। আর দ্রুত কিছু অর্জন করার চেষ্টা করলে টেকাও যাবে না। দ্রুত পরিচিতি অর্জন, দ্রুত টাকা অর্জন—সব পেতে চায়, কিছু দিতে চায় না। না দিয়ে যাঁরা পেতে চান, তাঁরা টিকবেন না। ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে না।

প্রথম আলো :

কত দিন ইত্যাদি করার ইচ্ছা আছে?

হানিফ সংকেত: আমার কাছে দর্শকের রায় চূড়ান্ত। তবে সেটা সমকালীন ভিউ বিচারে নয়। দর্শক যত দিন চাইবেন এবং যত দিন আমার অনুষ্ঠান করার সক্ষমতা থাকবে, তত দিন ইত্যাদি করে যাব।

প্রথম আলো :

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

হানিফ সংকেত: সবাইকে ধন্যবাদ।