তিন সপ্তাহ অনেক ছোটাছুটি করলেন।
মাকসুদ হোসাইন : সিনেমা মুক্তির পরে ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ছুটতে হয়েছিল। এ ছাড়া নিয়মিত ঢাকার হলোগুলোতেও ভিজিট করেছি। আপাতত কোনো হলে যাচ্ছি না। বাসায় আছি। তবে বিকল্পভাবে সাবা প্রদর্শনী করতেও অনেকে যোগাযোগ করছেন। সম্প্রতি ডিআইইউতে (ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) প্রদর্শনী হয়েছে। আরও অনেকেই বিকল্প প্রদর্শনীতে সিনেমাটি দেখতে চাইছেন। বলা যায়, এখনো সাবা নিয়েই ব্যস্ততা।
প্রথম আলো :
সিনেমাটি নিয়ে প্রত্যাশা কতটা ছিল?
মাকসুদ হোসাইন : বাণিজ্যিকভাবে অনেক সফল হবে, সেটা প্রত্যাশা ছিল না। তবে তৃতীয় সপ্তাহে এসে এখনো মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে চলছে। আগামী সপ্তাহেও চলবে। আমরা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো রিভিউ পেয়েছি। দর্শক, সমালোচক সবাই সিনেমাটি পছন্দ করছেন। এমন প্রশংসা কয়টা সিনেমার ভাগ্যে থাকে।
টরন্টো, সানড্যান্স, রেড সির মতো উৎসবে দেখানোর পর দেশের দর্শকদের সামনে প্রদর্শনের অভিজ্ঞতা কেমন?
মাকসুদ হোসাইন : মুক্তির পরে বুঝতে পেরেছি, দর্শক সিনেমাটি সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। যে কারণে বাড়তি একটি প্রচার পেয়েছি। গল্পটি একান্তই আমাদের। সেটা দেখে দর্শক পছন্দ করেছেন। আমাদের গল্প বলাকে গ্রহণ করেছেন, এটাও বেশ ভালো লেগেছে। ফর্মুলাভিত্তিক সিনেমার বাইরে নাচ নেই গান নেই—এমন একটি সিনেমাকে পছন্দ করাটা আমাদের মুগ্ধ করেছে। বুঝেছি, দর্শক গল্পের সঙ্গে নিজেদের কানেক্ট করতে পেরেছেন।
প্রথম আলো :
অনেকেই বলেন সিনেমা বানানোর চেয়ে মুক্তি দেওয়া কঠিন, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
মাকসুদ হোসাইন : বাংলাদেশের মতো জায়গায় সিনেমা বানানো অনেক কষ্টের কাজ। কিন্তু সিনেমা মুক্তি দেওয়া যে এতটা কঠিন, জানা ছিল না। অনেক দিন আগে থেকে আমাদের মুক্তির প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হয়েছে। অনেক কাগজপত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় সেগুলো দিয়ে আসতে হয়েছে। সিনেমা মুক্তির এই প্রক্রিয়া সহজ হওয়া উচিত। সিনেমা বানানো ও মুক্তি যদি পরিশ্রমের হয়, তাহলে তরুণেরা সিনেমা বানাতে উৎসাহ কম পাবে। তরুণদের জন্য সিনেমা মুক্তি খুবই সহজ করা উচিত।
খুব বেশি সিঙ্গেল হলে যেতে চাননি, আর্থিকভাবে এটা ক্ষতির কারণ হয়েছে কি না?
মাকসুদ হোসাইন : আমরা শুরুটাই করেছি কুমিল্লার সিঙ্গেল সিনেমা হল পালকি দিয়ে। সেখানে ১৯ সেপ্টেম্বর সিনেমাটি মুক্তি পায়। মুক্তির পরের সপ্তাহে আমরা বড় পরিসরে মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি দিই। আমাদের সিনেমা যে ঘরানার, সেটার সঙ্গে অনেক দর্শক পরিচিত নন। যে কারণে সব জায়গায় রিলিজ করিনি। আর আমাদের জীবনযাপন এমন, একটি সিনেমা দেখতে সময় মেলাতে হয়, তার ওপর যানজট পার হয়ে হলে যেতে হয়। যে কারণে ঈদ ছাড়া মানুষের সিনেমা হলে যাওয়ার অভ্যাসটা কম। দর্শকদের সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকলে সিনেপ্লেক্স থেকেও প্রযোজক লাভবান হতে পারেন।
শুরুতে একটি হলে কেন মুক্তি দিলেন?
মাকসুদ হোসাইন : মুখ্য কারণ ছিল পূজার সময়টা ধরা। এখানে এক সপ্তাহে দুটির বেশি সিনেমা মুক্তি দেওয়ার নিয়ম নেই। যে কারণে আমরা ১৯ সেপ্টেম্বর একটা হলে সীমিত পরিসরে মুক্তি দিই পরের সপ্তাহ ধরার জন্য। তখনো আমরা ভেবেছিলাম পরের বছর অস্কার ধরব। কিন্তু অস্কারের নিয়ম জানার পরে দেখা গেল সিনেমাটি এ বছরেই অস্কারের জন্য জমা দিতে হবে। তখন অস্কারের জন্য জমা দিই। কারণ, পরে আর সুযোগ থাকবে না।
প্রথম আলো :
‘সাবা’ কতটা পরীক্ষামূলক ছিল?
মাকসুদ হোসাইন : সেই অর্থে ‘সাবা’কে আমি এক্সপেরিমেন্টাল (নিরীক্ষাধর্মী) বলব না। সিনেমায় না বোঝার মতো বা কঠিন কোনো বিষয় নেই। বর্তমান দর্শক ভারত বা হলিউডের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত। সেখানে বেশির ভাগ গল্পই অনেক বেশি বলে দেওয়া হয়। বেশির ভাগই মেলোড্রামা। আমার সিনেমায় মেলোড্রামা নেই। ‘সাবা’তে আমি ৭০ ভাগ গল্প একেবারেই বলে দিয়েছি। বাকি ৩০ ভাগ হয়তো দর্শকদের গল্পের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে বুঝে নিতে হবে, কী কারণে কী হচ্ছে।
আপনি হলিউডে পড়াশোনা করেছেন, কাজ শিখেছেন। ওখানেই কাজ করলেন না কেন?
মাকসুদ হোসাইন : আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম ১০ বছর। ওই সময় সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু কোনো গল্প নিয়ে কাজ করতে গেলেই দেখা যেত দেশের কোনো একটি প্রেক্ষাপট ভাবতাম। যেটা নিজের চেনা গল্প। ওই সময়ে চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বানিয়েছি। সবই ছিল দেশের বিষয়বস্তু। এর মধ্যে একটি গল্প তো স্টুডেন্ট অস্কার জয় করে। পরে ক্যারিয়ার নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখন মনে হলো আমার চেনা গল্পগুলো দেশেই রয়েছে। দেশের কালচারের গল্প, আমাদের নিজস্ব ইমোশন আমাকে তুলে ধরতে হবে, যে গল্প বলে দেবে এটা বাংলাদেশের সিনেমা। আমাকে ‘সাবা’র মতো সিনেমা বানাতে হবে।
সিনেমাটি অস্কারে গেল না, এই নিয়ে...
মাকসুদ হোসাইন : কানাডার টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব দিয়েই তাদের প্রচার শুরু করে একাডেমি। সেই উৎসবে আমাদের সিনেমাটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়, আলোচনায় আসে; প্রশংসিত হয়। পরে ‘সাবা’ নিয়ে প্রথম সারির অনেক উৎসবে আমরা ঘুরেছি। ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে রিভিউ ছাপা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাবার আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, দর্শক রয়েছে। সিনেমার মানও অবশ্যই ওই মানের। না হলে এত দেশের উৎসবে তো যেত না। এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো সিনেমা একই সঙ্গে এত বড় বড় উৎসবে গিয়েছে কি না জানি না। সেখানে আমাদের প্রত্যাশা ছিল সিনেমাটি দেশ থেকে অস্কার মনোনয়নের জন্য পাঠানো হবে। কিন্তু দেশের জুরিরা আমাদের সিনেমাটি পছন্দ করেননি কেন জানি না।
এ নিয়ে কোনো অভিমান?
মাকসুদ হোসাইন : অভিমানের কিছু নেই। আমি জুরিদের সম্মান করি। তবে অস্কার পাঠানোর আগে একটি সিনেমা আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটা বিবেচনায় রাখা উচিত। অস্কারের বিচারকেরা আন্তর্জাতিক মানটাই দেখেন। এখন দেশ থেকে কোন প্রক্রিয়ায় আর কোন চিন্তায় সিনেমা বাছাই করা হয়, সেটা দেশের অস্কার কমিটি জানে। তবে জুরি সদস্যরা ভাবতে পারতেন, সাবা টরন্টো, রেইনড্যান্স, রেড সি, বুসান, সিডনি, গোথেনবার্গসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে অংশ নিয়েছে। শুধু শুধু কি একটি সিনেমা কোনো ভালো উৎসবে মনোনয়ন পায়? এটা নিয়ে আর বলার কিছু নেই।
প্রথম আলো :
আপনার পরবর্তী সিনেমার পরিকল্পনা কী?
মাকসুদ হোসাইন : প্রথম সিনেমা নিয়ে দীর্ঘ একটা সময় চলে গেল। এর মধ্যেই দ্বিতীয় সিনেমার কাজ এগিয়ে নিয়েছি। চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেছি। সিনেমাটির নাম বেবিমুন। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও দেশের প্রযোজকেরা যুক্ত রয়েছেন। আগামী বছরে সিনেমাটির শুটিং শুরু করতে চাই। সেভাবেই এখন পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে।