বিদেশে সেটেল্ড হওয়ার চিন্তা সিরিয়াসলি কখনো আসে না: মোশাররফ করিম

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের গল্প ‘কিছুক্ষণ’ অবলম্বনে নির্মিত ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। সম্প্রতি তাঁকে দেখা গেছে চরকি অরিজিনাল ‘ডিমলাইট’ ফিল্মে। অভিনেতার ব্যস্ততা ও জীবনের নানা বিষয়ে কথা শুনেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজমুল হক

প্রথম আলো:

‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ছবিটি করার সিদ্ধান্তে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে?

মোশাররফ করিম : এ গল্প আগে হয়নি, এ রকম গল্পও হয়নি আসলে, এটা দারুণ এবং অসাধারণ একটা গল্প। আমার কাছে যখন নতুন কোনো চিত্রনাট্য বা চরিত্র আসে, তখন আমি প্রথমে দেখি যে চরিত্রটা আমি করতে পারব কি না বা চরিত্রটাকে আমি নিজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি কি না। অনেক সময় চরিত্র ভীষণ ভালো লাগে, কিন্তু মনে হয়, ওটা করার ক্ষমতা আমার নেই বা আমি চরিত্রটাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারছি না, তখন আফসোস হয়। কিন্তু চরিত্রটাকে যখন নিজের ভেতরে দেখতে পাই, সেই আনন্দের জন্যই আসলে আমি কাজটা করি।

‘ডিমলাইট’–এর পোস্টারে মোশাররফ করিম। চরকির সৌজন্যে

প্রথম আলো :

আমাদের এখানে একই ধরনের চরিত্রে বারবার কাস্ট করার একটা চর্চা আছে। এটা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

মোশাররফ করিম : এটা দীর্ঘকালের ট্রেন্ড, বিশেষ করে উপমহাদেশে একই ধরনের চরিত্রে একই লোককে বারবার কাস্ট করার একটা চর্চা আছে। কেউ সারা জীবন শুধু তথাকথিত হিরো চরিত্র করে যাবে, কেউ ভিলেন বা কেউ শুধু কমেডি—এই যে ফিক্সড করে ফেলা, এটা একটা মনোটনি বা একঘেয়েমি তৈরি করে। তখন অভিনেতা হিসেবে সব সময় ভেরিয়েশন ক্রিয়েট করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপরও আমি চেষ্টা করি একটা চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, সেটা খুঁজে বের করতে। তবে সত্যি বলতে, একই জিনিস বারবার করাটা ক্লান্তিকর এবং বিরক্তিকরও বটে।

প্রথম আলো:

ক্লান্তি ও বিরক্তির পরও না করতে পারেন না কেন? এগুলো করার পেছনে সম্পর্কের দায়বদ্ধতা নাকি জীবিকার প্রয়োজন বেশি কাজ করে?

মোশাররফ করিম : জীবিকার প্রয়োজনীয়তা তো আছেই, কিন্তু সেটা খুব বড় কারণ না; কারণ, মানুষের প্রয়োজন তো সীমাবদ্ধ। এখানে আসলে আমার নিজের অলসতা বা দোষ দেওয়াটাই ভালো। আমি নিজেকে গ্রেট বানাতে চাই না, আমি খুব একটা ডিসিপ্লিনড মানুষও নই। অনেক সময় হয়তো ভাবি কাজটা না করলেই হতো, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ চলে আসে যে আচ্ছা করে দিই। শুধু আমার কাছের মানুষ না, অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একজন তিন-চারবার আমার কাছে আসছে, তখন একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত কাজটা করতে হয়। এই জায়গাটা ঠিক করার চেষ্টা করছি অনেক দিন ধরে।

মোশাররফ করিম
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো :

এসব নিয়ে দর্শক ও ভক্তদের সমালোচনা চোখে পড়ে?

মোশাররফ করিম : এই যুগে ফেসবুকের মন্তব্য দেখে কে ভক্ত আর কে ভক্ত না, সেটা বোঝা মুশকিল। মানুষ বুঝে বলছে নাকি না বুঝে বলছে, সেটা অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। তাই অন্যের সমালোচনার চেয়ে আমার নিজের সেলফ অ্যাসেসমেন্ট বা আমি নিজে কী ফিল করছি, সেটাই আমার কাছে বড়। সত্যি বলতে, আমার নিজেরও অনেক সময় রিপিটেড ক্যারেক্টার করতে ইচ্ছা করে না।

প্রথম আলো:

তাহলে এর পেছনে দায়টা কার? শিল্পী নাকি নির্মাতা-প্রযোজকের?

মোশাররফ করিম : আমার মনে হয়, দর্শক যা চায়, আমি সেটাই দেখাচ্ছি—এই অজুহাত দেওয়ার কোনো দরকার নেই। দায় সবারই আছে। তবে আমি শিল্পীরটা বলতে পারি। দর্শক হয়তো গুড়ের বাতাসা খেতে অভ্যস্ত; কারণ, সে ওটাই দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে আসছে। শিল্পী হিসেবে আমার কাজ হলো সেই উপাদান ঠিক রেখে তাকে গুড়ের সন্দেশ বানিয়ে দেওয়া। শিল্পের কাজই হলো সাধারণ জিনিসকেও সুন্দর কারও কাজের মাধ্যমে অসাধারণ করে তোলা।

মোশাররফ করিম
প্রথম আলো

প্রথম আলো :

নাটকের বাজেট তো এখন অনেক বেড়েছে। তারকাদের পারিশ্রমিক ছাড়া সৃজনশীল বা গুণগত মানের কি কোনো উন্নতি দেখছেন?

মোশাররফ করিম : বাজেট বাড়লেও যদি উন্নতি না হয়, তবে তার প্রধান কারণ হলো স্কুলিং বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। আমাদের দেশে কোনো ভালো ফিল্ম ইনস্টিটিউট নেই, অথচ এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ভালোবাসার টানে ১০-১৫ জন আন্তর্জাতিক মানের ডিওপি বা নির্মাতা বের হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের চেষ্টায় শিখেছেন, এটা স্যালুট দেওয়ার মতো একটা বিষয়। আমাদের হলে দর্শক ফিরেছে, বিদেশেও সিনেমার হাউসফুল শো যাচ্ছে। বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে, পুরস্কার পাচ্ছে।

প্রথম আলো:

নাট্যকেন্দ্রের ৩৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সবাই একত্র হয়েছিলেন। নতুন কোনো নাটক নিয়ে আপনাকে আবার মঞ্চে দেখার সম্ভাবনা আছে?

মোশাররফ করিম : মঞ্চে ফিরতে আমার খুব ইচ্ছা করে, কিন্তু ভেতরে একটা ভয়ও কাজ করে যে আমি যেভাবে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ফেঁসে আছি, তাতে সময় বের করতে পারব কি না। তবে সুযোগ পেলে মঞ্চে কাজ করতে পারলে আমার ভীষণ ভালো লাগবে।

মোশাররফ করিম
ছবি : সংগৃহীত

প্রথম আলো :

অভিনেতাদের অনেকেই নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যতে আপনাকে কি পরিচালনায় দেখা যাবে?

মোশাররফ করিম : মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে মনে হয় ক্যামেরাটা ওভাবে বসালে ভালো হতো, লাইটের প্লেসমেন্ট ঠিক হয়নি, গল্পটা এমন হতে পারত। কিন্তু নির্মাণের ব্যাপারে সিরিয়াস কোনো ভাবনা এখনো নেই। হয়তো কখনো নির্মাণে আসব, হয়তোবা আসব না। সব সময় বলে দেবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

টানা কাজ করতে গিয়ে কি কখনো ক্লান্তি আসে না?

মোশাররফ করিম : মাঝেমধ্যে চাপের কারণে মনে হয় যে ধুর, আর করব না, কিন্তু আবার ১০-১২ দিন গ্যাপ দিলে ভালো লাগে না, মনে হয় কখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব। আমাদের কাজে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম অনেক বেশি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সাধারণ মানুষেরা সন্ধ্যার পর ফ্রি হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। একদিন দুপুরের পর কাজ ছিল না বলে ঘুমিয়ে ছিলাম, বিকেলে বের হয়ে মনে হলো, বিকেলের রোদ বা বিকেলবেলা ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ কত দিন পর পেলাম! কদিন আগে পুবাইলে শুটিং করছিলাম, শুটিং দেখতে আসা সাধারণ মানুষ যখন সেজেগুজে পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়ায়, তখন তাদের দেখে মাঝে ঈর্ষা হয়েছিল। এরপরও দিন শেষে আমি আমার কাজটাই উপভোগ করি।

প্রথম আলো :

সহশিল্পীদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আপনার পরিকল্পনা কী?

মোশাররফ করিম : বিদেশে সেটেল্ড হওয়ার চিন্তা সিরিয়াসলি কখনো আসে না। আমি এই নগরীকেও পছন্দ করি, আবার আমার গ্রামের বাড়িকেও ভালোবাসি। ভবিষ্যতে কোথায় যাব বা কী হবে, তা তো আসলে বলা যায় না, আল্লাহ ভালো জানেন।