শারমিন হয়ে ওঠার যাত্রাটা কেমন ছিল?
মহসিনা আক্তার : আমার মনে হয়, অভিনেতা কখনো কোনো চরিত্র হয়ে উঠতে পারে না, চরিত্রের দিকে যাত্রা করা যায়। এখানে দ্বৈত সত্তা কাজ করে, অভিনেতার নিজের সত্তাটা কিন্তু সব সময় চরিত্রের পেছনে সচেতনভাবে থাকে। এ কারণে সে অ্যাকসিডেন্ট করে বসে না, খুনের দৃশ্যে খুন করে না, ভালোবাসার দৃশ্যে ভালোবেসে ফেলে না। না হয় কী বিপদ হতো বলেন তো (হাসি)! তো এটা আমার জন্য একটা যাত্রা ছিল, যে মানুষটা আমি নই, সে মানুষটার কাছাকাছি পৌঁছানোর যাত্রা। শারমিনের মতো চরিত্র আশপাশে আমরা অনেক দেখি, চরিত্রগুলো আমাদের পরিচিত, আমার-আপনার ঘরে আছে, কিন্তু এই মানুষগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে ও বুঝতে চাই না। এটা একটা সুযোগ ছিল, ওই মানুষটার অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাত্রা করার একটা সুযোগ। সেই যাত্রায় আমি শারমিনের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করেছি।
প্রথম আলো :
অভিনয় করছেন অনেক বছর, চলচ্চিত্র মাধ্যমে কাজ করে কতটা পার্থক্য দেখছেন?
মহসিনা আক্তার : অনেক পার্থক্য। এটা তো সরাসরি দর্শকের জন্য নয়। সারাক্ষণ একটা ক্যামেরা মুখের সামনে তাক করা থাকে। এই ফিল্মে একটা দৃশ্যে যেখানে বলে ‘আমার কোনো ছেলে নাই’, সেখানে তো একদম মুখের কাছে চলে এসেছিল লেন্স। তো সেইটাকে ভুলে গিয়ে পারফর্ম করা দরকার। তবে এটা কোন মাধ্যমে যাবে চিন্তা করে আমি কাজ করিনি। কাজের ক্ষেত্রে সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করেছি, এটা কোন মাধ্যমে দেখানো হবে, সেটা এখানে যায়-আসে না।
কতটা চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে?
মহসিনা আক্তার : সব চরিত্রই চ্যালেঞ্জিং, যদি ঠিকভাবে করার ইচ্ছা থাকে। সে ক্ষেত্রে বলতে গেলে ওই রকম আলাদা করে কোনো চ্যালেঞ্জ কাজ করেনি বড় পর্দা বলে। পরিশ্রম করেছি, সংযম করেছি, মঞ্চের কাজেও যেমনভাবে করি। এইটা সাঁতার জানার মতো। আপনি সাঁতারে প্রশিক্ষিত হলে সব জলেই সাঁতার কাটতে পারবেন। পুকুরে সাঁতার কাটছেন, নাকি সমুদ্রে, তা কিন্তু বিষয় নয়, পানির চাপটা বুঝে সাঁতারটা ঠিকঠাক কাটতে হবে। এখানে অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমার তা-ই মনে হয়েছে। আমি তো পারফরমার, আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তো সব সময় থাকে। তবে তা নতুন মাধ্যমের জন্য নয়; বরং ভালো কাজ করার চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো :
সিনেমা তো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়। সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করলে পানির চাপ একটু বেশি ছিল কি?
মহসিনা আক্তার : দেখুন, সিনেমাকে সমুদ্র বলব, নাকি মঞ্চকে, সেই তুলনায় যাচ্ছি না। দুইটাই মহান শিল্পমাধ্যম। তবে এটা ঠিক, আমি যে মাধ্যমে কাজ করি, সেখানে সীমিত মানুষের উপস্থিতি। কিন্তু সিনেমা থেকে যায়; মানুষ ঘরে দেখে, বাইরে দেখে, ফোনে দেখে; বারবার দেখে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পায়। তাই এখানে একটা চাপ তো আছে অবশ্যই। আর এটা আমার জন্যও পজিটিভ, নিজেও কাজটাকে বিশ্লেষণ করতে পারব, কোথায় অপারগতা আছে।
লকডাউনে শুটিং কতটা কঠিন ছিল?
মহসিনা আক্তার : লকডাউনে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা এক অর্থে অসাধারণ। কারণ হলো, ধরুন আপনার সাংবাদিকতা বন্ধ করে দিলাম, আপনার কত দিন ভালো লাগবে? লকডাউনে আমাদের সব কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ কাজটা যখন করি, ওই সময় লকডাউন একটু একটু করে শিথিল হচ্ছিল। ঝুঁকি ছিল, তবে সচেতনভাবেই আমরা তা মোকাবিলা করেছি। বাইরে বাইরে থেকেছি ১৫ দিন, যেন ওই সময়ে পরিবারের কাছে না যেতে হয়। সব রকম নিয়ম মেনে অল্প কয়েকজন মিলে কাজটি শেষ করেছি। বলা যায়, একদম বন্দী ছিলাম। যথেষ্ট সচেতন থেকেছি, বারবার টেম্পারেচার থেকে কোভিড টেস্ট করেছি।
প্রথম আলো :
অভিনেতা, শিক্ষক, কস্টিউম ডিজাইনার-এত কিছু সমন্বয় করেন কীভাবে?
মহসিনা আক্তার : এটা অনেক কঠিন। শৈল্পিক জায়গা থেকে দেখলে, এটা আমাকে অর্জন করতে হয় বা হয়েছে। যখন আমি অভিনয় করি, তখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবি না। কারণ, আমার মাথায় যদি সারাক্ষণ কস্টিউম কী হবে থেকে অন্যান্য কিছু ঘুরতে থাকে, তাহলে আমি অভিনয়ের সঙ্গে অসততা করছি। আমাকে বেশির ভাগ সময় ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, শুক্র-শনি নেই জীবনে। কোনো আড্ডায় আমাকে কিন্তু দেখবেন না। অনেকে মনে করে, এটা কি আমি ইচ্ছা করে করি? আমার মনে হয় না; কারণ, আমি যদি কাজটাকে ভালোবাসি তো কাজটা আগে, তাই না? প্রচার-প্রচারণা, সবকিছুর আগে কিন্তু কাজটা। তো কাজের জন্য অবশ্যই আমাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সব সমন্বয় করার জন্য জীবনে আমাকে অনেক কিছু বাদ দিতে হয়। বেড়াতে যাওয়া, একটু ঘোরাফেরা, অবসর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। হয় ভালো করে করো, না হয় ছেড়ে দাও। কারণ, শিল্পের পথ মসৃণ নয়।
অন্যের নির্দেশনায় কাজ করার সময় অভিনয়, কস্টিউম নিয়ে কি নির্মাতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়?
মহসিনা আক্তার : না, কখনো হয়নি। কারণ, আমি এটা মানি, একবার যদি আমি কোনো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হই, তবে তার নির্দেশ মানতে হবে। না হয় নিজেরসহ পুরো কাজই নষ্ট হবে। জয়া আর শারমিন-এর কস্টিউম করেছেন আনিকা জাহিন, আমি কিন্তু একবারও কোনো কথা বলিনি পোশাক কেমন হওয়া দরকার, এ নিয়ে। তবে নিজে কস্টিউম করি বলে আমি জানি, অভিনেতারা এখানে খুব নখরা করে। অনেকে চরিত্রের কথা ভাবেন না, নিজের কথা ভাবেন। এটা কিন্তু বিয়েবাড়িতে যাওয়া নয়। আমি যখন কোনো নাটকে অভিনয় করি, যেখানে আমাকে ডিজাইনও করতে হবে, তখন সবার পরে আমি আমার সবকিছুর ডিজাইন করি; অনেক সতর্ক থাকি। একটা নাটকের উদাহরণ দিই-‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’। আমি দুবার মাথা ন্যাড়া করেছি। আমার পরিচালক কি বাধ্য করেছেন? না, উনি বলেছেন, ‘এটা আপনার স্বাধীনতা, আপনি ন্যাড়া না করলে যে চরিত্র হবে না, তা কিন্তু নয়।’একজন ডিজাইনার কিন্তু পুরো লুক দেখেন। আমি দেখে ফেলেছি, ন্যাড়াটা করতে হবে। আমি নিজেকে বলেছি, অসততা করে যদি আমি এটা না করি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য অভিনেতাকে কীভাবে বলব?
প্রথম আলো :
এসব বিষয়ে কি জামিল আহমেদ স্যারের প্রভাব আছে?
মহসিনা আক্তার : এত লম্বা সময় স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি, এত কিছু শিখেছি। সব শিক্ষক তো আর স্বপ্ন দেখাতে পারেন না, উনি পারেন। আর উনি এত সৎ! যেটা বলেন, সেটা করেন। আর আমার শিক্ষক আমার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করছেন, রিহার্সাল ফ্লোরে চেয়ার টানা থেকে শুরু করে সবকিছুতে। আবার আমরা যা খাচ্ছি, উনিও তা খাচ্ছেন। আবার পড়ালেখায়, জীবনবোধে তিনি সবার আগে। তো আমি তাঁর থেকে প্রভাবিত হব না তো কার দ্বারা হব!
চলচ্চিত্র নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা...
মহসিনা আক্তার : কে জানে ভবিষ্যতে কী হবে। আজ যেটা বলছি, তা হয়তো বদলে যেতে পারে। আমি একটা সময় একদম অতলে থাকতাম। বলা যায়, কাজ নিয়ে ডুবে থাকা। এই ভেসে ওঠাও কিন্তু কোভিডের জন্য। ওই সময় লকডাউন না থাকলে অবশ্যই অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতাম। এমন নয় যে কাজের প্রস্তাব পাইনি, সে সময় নাটকের সঙ্গে সময় মেলেনি বলে আমি ক্ষমা চেয়েছি। কারণ, আমি কথা দিয়েছি মানে কথা দিয়েছি। তো ওটা যদি ভিজ্যুয়ালেও আমি আগে কাউকে কথা দিই, তাহলে আমি ওটা শেষ করেই কিন্তু আমার কাজে ফিরব। অভিনেতা তো সব মাধ্যমেই কাজ করতে চায়। সবার কাছে দোয়া চাই যেন আরও অনেক গল্প বলতে পারি, মানুষের কথা তুলে ধরতে পারি, অনেক চরিত্রের মধ্য দিয়ে জীবনের বোধকে আরও তীব্র করতে পারি।