কেমন আছেন?
আফসানা মিমি : একটু আগে শুনলাম, উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর। ভয়াবহ দুর্ঘটনা। জীবনে কিছু কিছু সময় আসে, যখন কোনো শব্দ থাকে না, আজ সে রকম একটা দিন। মাইলস্টোনের এ ঘটনা সবার চোখে জল আনার দিন। আমাদের ইচ্ছেতলার কয়েকজন মাইলস্টোনে পড়ে। তাদের মধ্যে দুজনের আজ পরীক্ষা ছিল, তারা দুর্ঘটনার আগেই বাসায় ফিরেছে। তবে আমাদের সবার মন খারাপ। সবাই সবার খোঁজখবর নিচ্ছে। কাদের রক্ত লাগবে, এটা নিয়েও কাজ করছে।
‘ইচ্ছেতলা’র পরিচালক আপনি। আপনার প্রতিষ্ঠান ‘বনের ধারে নদী’ নামের একটি নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। শিশু-কিশোরদের জন্য এই উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
আফসানা মিমি : শিশু-কিশোরদের নিয়ে বাচ্চাদের জন্য আনন্দময় পৃথিবী তৈরি করতে চাই। আমি আসলে নতুন প্রজন্মকে না, পুরোনো প্রজন্মকে বার্তা দিতে চাই। আমি বাবা-মা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবাইকে বলতে চাই, পড়াশোনার পাশে সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বাচ্চাদের খেলাধুলা বা সংস্কৃতিচর্চা—যেকোনো একটার সঙ্গে যুক্ত থাকা ভীষণ জরুরি। আমি যেহেতু সংস্কৃতিচর্চাটা বুঝি, তাই এটি নিয়ে কাজ করছি; যদি স্পোর্টসম্যান হতাম, তাহলে খেলাধুলা নিয়ে কাজ করতাম।
প্রথম আলো :
দীর্ঘদিন পর ‘উৎসব’ সিনেমায় আপনার অভিনয় নিয়ে আলোচনা চলছে।
আফসানা মিমি : যুক্ত হওয়ার প্রথম কারণ পরিচালক তানিম নূর, কারণ তিনি আমাকে চেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জাহিদ হাসান। কারণ, দুই বন্ধু মনে হয় ২০ বছর পর একসঙ্গে কাজ করলাম। বন্ধন নাটকের পর আমরা সম্ভবত হিতে বিপরীতে নামে হানিফ সংকেতের একটা কাজ করি। তাই এই কাজটা চরম আগ্রহ এবং আনন্দের বিষয়। আর তানিম নূর আমাকে যখন বলেছিলেন, ’৯০–এর দশকের ফিলটা নিয়ে আসতে চান। নস্টালজিয়াটার মধ্যে নিয়ে যেতে চান দর্শককে বা আমাদের। তৃতীয় হচ্ছে আমার চরিত্র। যে কারও কাছে মনে হতে পারে খুব ছোট্ট চরিত্র, কিন্তু এর গুরুত্ব অনেক। খুবই ইমপ্যাক্টফুল। গল্পটা ভীষণ ভালো লেগেছে, সঙ্গে এতগুলো মানুষের সঙ্গে অভিনয় করতে পারব।
এখন তো আপনাকে খুব বেছে বেছে অভিনয়ে দেখা যায়।
আফসানা মিমি : না, না—এটা আমি শুধু বেছে কাজ করি, তা না। পরিচালক–প্রযোজকদেরও তো আমাকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আমি মানসিক দিক থেকে শতভাগ কাজ করার জন্য ফিট। এটাও ঠিক, আমি তো এখন সব চরিত্রের জন্য মানানসই হব না। আমার অভিনয়প্রতিভাকে কেউ যদি লাগাতে চান, তিনি তো আমাকে খুঁজে নেবেন। যাঁরা খুঁজে নেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করি। এটাও তো সত্যি, গড়পড়তা কাজ করতে ভালো লাগে না আমার।
প্রথম আলো :
কোন ধরনের প্রজেক্ট আপনাকে টানে?
আফসানা মিমি : আমাকে টানে সেই ধরনের প্রজেক্ট, যেখানে দেখতে পাই ডিরেক্টরের চিন্তাটা খুব স্বচ্ছ, পরিষ্কার। তিনি জানেন যে তিনি কেন কাজটা করতে চান এবং তাঁর একটা ফিলোসফি আছে। তখন গল্পটাও ঠিকঠাক থাকে। যে কাজে নির্মাতার কোনো উদ্দেশ্য বা দর্শন থাকে না এবং কাজটা কেবল জীবনধারণের জন্য করা হয়—সেই কাজের সঙ্গে আমি থাকতে চাই না। আমি থাকতে চাই, যেখানে একজন পরিচালক দার্শনিকভাবে কাজটা করতে চান এবং আগ্রহ অনুভব করেন যে এই কাজটা করার জন্য আমাকে প্রয়োজন।
’৯০-এর দশক থেকে আপনি কাজ করছেন। সব কাজ কি আপনার ভেতরের তাগিদ থেকে এসেছিল, নাকি টিকে থাকার জন্যও?
আফসানা মিমি : একটা সময় আসলে কোনটা তাগিদ আর কোনটা সারভাইভিং, বুঝতাম না। তখন পাগলের মতো কাজ করতাম, কাজ করতে পারাটাকেই সার্থক মনে হতো। কারণ, যা করতাম ভালোবেসেই করতাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝেছি যে কোন কাজগুলো সত্যি সার্থকতা দিয়েছে আর কোন কাজগুলো না হলেও খুব একটা অসুবিধা হতো না। সময়ের সঙ্গে আমরাও বড় হই এবং আমাদের বিচার-বিবেচনা পরিণত হয়। ’৯০-এর দশকে আমি যতগুলো কাজ করেছি, আজকের দিনে বললে তার থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ কাজ ফেলে দিতাম। তবে কাজের প্রতি ভালোবাসা কখনোই কম ছিল না, সেটা টিকে থাকার জন্যই হোক বা না হোক।
প্রথম আলো :
অভিনয়ের পাশাপাশি আপনি তো পরিচালনাও করে থাকেন?
আফসানা মিমি : হ্যাঁ, আমি পরিচালনা করে থাকি। আগে বেশি করতাম, এখন একটু টায়ার্ড লাগে। শুটিংয়ে কিছু ঠিক না থাকলে এত চিৎকার-চেঁচামেচি করি যে মনে হয় অন্যদের হয়তো আতঙ্কিত করে ফেলি।
পরিচালনা না অভিনয়—কোনটা আপনাকে বেশি সন্তুষ্টি দেয়?
আফসানা মিমি : দুটিতেই দুই রকম আনন্দ পাই। এ মুহূর্তে আমি অভিনয়ে একটু ফোকাস বেশি, কারণ অভিনয়ে দায়িত্ব কম। প্রোডাকশনে দায়িত্ব বেশি, তাই প্রোডাকশন থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করছি। দুটিতে দুই রকম আনন্দ। যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে কোন কাজটা ভালো পারি, তাহলে বলব অভিনয়টা আমি পরিচালনার চেয়ে ভালো পারি। আমি একজন মোটামুটি মানের পরিচালক, কিন্তু একজন ভালো অভিনেত্রী—অন্তত যেটুকু আমি নিজেকে বলতে পারি।
প্রথম আলো :
অভিনয়ের শুরুতে আপনার কী ধরনের স্বপ্ন ছিল এবং সেগুলোর কতটা পূরণ হয়েছে?
আফসানা মিমি : দুটি স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল মঞ্চে শেক্সপিয়ারের কোনো একটা নারী চরিত্রে অভিনয় করব। একবার আলী যাকের কিং লিয়ার করতে চেয়েছিলেন, তখন আমি শয়নে–স্বপনে কর্ডেলিয়া চরিত্রের কথা ভাবতাম। এখন আমার বয়স এবং মানসিক পরিপক্বতা অনুযায়ী মনে হয়, লেডি ম্যাকবেথের মতো চরিত্রে অভিনয় করতে খুব ভালো লাগবে। টেলিভিশনের জন্য আমার খুব ইচ্ছা ছিল কেউ আমাকে রবীন্দ্রনাথের কোনো চরিত্রে নেবে। একদম ছোটবেলায় ১৯৯২ সালে গুপ্তধন নামে একটি নাটকে একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম, মূল চরিত্রে ছিলেন গোলাম মুস্তাফা ও হুমায়ুন ফরীদি। ওখানে ছোট্ট চরিত্র করেছিলাম, হুমায়ুন ফরীদির স্ত্রীর, কিন্তু তাতে স্বাদ মেটেনি। রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের শক্তিশালী যেসব চরিত্র, সেগুলোতে কাজ করার খুব আগ্রহ ছিল। এই দুটি স্বপ্ন এখনো রয়ে গেছে। আমি মনে করি, একজন অভিনেতা চাইলে আমৃত্যু অভিনয় করে যেতে পারেন, আমাদের দেশেই এর অনেক উদাহরণ আছে। আমার অসম্ভব প্রিয় মানুষ, মিরানা জামান ও দিলারা জামান—এঁরা হচ্ছেন আমার কাছে আইকন, তাঁদের মতো সুন্দর এবং সার্থক হতে চাই।