সুচন্দার স্মৃতিতে: জহির রায়হানের শেষ কথা ও শেষ দিনের ঘটনা

বাংলাদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন জহির রায়হান। মাত্র ৩৭ বছরের জীবন ছিল তাঁর। কিন্তু এই স্বল্পায়ুর জীবনের বৃহৎ অংশজুড়ে ছিল দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির তাড়না। গণমানুষের মুক্তির পথ হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, তা সঞ্চারিত হয়েছিল জহির রায়হানের মধ্যেও, যা তাঁর শিল্পীসত্তা গঠনে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আজ ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হানের প্রয়াণদিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে সহোদর শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে বের হয়ে তিনি মিরপুরে হত্যার শিকার হন। ২০২১ সালে জহির রায়হানের প্রয়াণদিবসে তাঁর স্ত্রী, বরেণ্য অভিনয়শিল্পী কোহিনূর আক্তার সুচন্দার সঙ্গে কথা হয় ‘বিনোদন’–এর। মনজুর কাদের-এর নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ আবার প্রকাশ করা হলো।

প্রথম আলো:

প্রতিদিনই তো কোনো না কোনোভাবে জহির রায়হানের কথা মনে হয়। কিন্তু এই দিনে আপনার স্মৃতিতে তিনি কীভাবে আসেন?

নানাভাবে আমার স্মৃতিতে জহির রায়হানের বিচরণ। প্রথম পরিচয়ের লগ্ন থেকে শেষযাত্রা পর্যন্ত—সবকিছু আমার মনে পড়ে। বসে বসে কত–কী ভাবি, কত–কী স্মৃতিচারণা করি—কোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ। তার রাজনীতি, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, পারিবারিক জীবন—সবই মনের মধ্যে উঁকি দেয়। কাজ করতে করতেই আমাদের ভালোবাসার জন্ম হলো। যদিও জহিরের সঙ্গে সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনের স্মৃতি আমি খুব একটা খুঁজে পাই না। পুরাই কাজপাগল একজন মানুষ ছিল। সারাক্ষণ কাজের মধ্যেই ডুবে থাকত। পারিবারিক জীবন যে একটা জীবন; স্ত্রী, সংসার, সন্তানদেরও যে সময় দেওয়ার দরকার, সেইটা আমি কিন্তু তার কাছ থেকে সেভাবে পাইনি। এ নিয়ে অনেক অপূর্ণতা থাকলেও এসব নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। জহির রায়হান অনেক গুণের মানুষ, তবে বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব থাকে, স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য—সেটা কিন্তু জহির ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ হলে বিষয়টাকে আমি অন্যভাবে নিতাম। সবকিছু ভেবেই আমি ত্যাগ স্বীকার করেছি। জহির তো আমার একার না, দেশের সবার কথা ভাবত। পোড়খাওয়া মানুষ, ঘুণে ধরা সমাজ—এসবের কথাই সব সময় ভেবেছে। এসব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিতাম। আমিও খুব ব্যস্ত ছিলাম। দেখা যেত, আমি যখন বাসায় ফিরতাম, জহির তখন কাজে বের হতো। পড়াশোনা করে যতটা জেনেছি, গুণী মানুষদের জীবনটা বুঝি এ রকমই হয়। তাঁরা একটু বোহিমিয়ান স্বভাবের। তাই আমার রাগ, ক্ষোভ, কিছুই ছিল না।

প্রথম আলো:

আপনি ত্যাগের কথা বলছিলেন, আপনার কাজে কি তিনি কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতেন?

একদমই না। আমাকে অনেক বেশি উৎসাহ দিত। কখনো বলেনি, ‘তুমি এই কাজ করতে পারবে না বা করা উচিত না।’ বরং আমাকে এ–ও বলেছে, ‘তোমাকে যতটুকু বুঝেছি, পরিচালনা করলে তুমি ভালো করতে পারবে।’ আমি বলেছিলাম, আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, তারপর নাহয় দেখা যাবে। যুদ্ধের আগে সে বলেছিল, আমি একটা চিত্রনাট্য করে দেব, তুমি ডিরেকশন দেবে। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।

প্রথম আলো :

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি আসলে কী হয়েছিল?

এ তো অনেক বড় ঘটনা। অল্প সময়ে বলা সম্ভবও না। তারপরও যদি বলতে হয়, পুরান ঢাকার বি কে গাঙ্গুলী লেনের শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাসা। সকালের নাশতা বানাচ্ছি। এমন সময় বাসার কাজের ছেলে এসে বলল, ‘স্যার, বাসার নিচে আর্মির পোশাক পরা একজন লোক এসেছেন। আপনাকে নিচে যেতে বলেছেন।’ জহির বলল, ‘ঠিক আছে। বলো আমি আসতেছি।’ না খেয়ে নিচে নেমে গেল।

প্রথম আলো:

পুলিশ, নাকি আর্মির লোক, আপনি কি দেখেছিলেন?

আমি দেখিনি। পুলিশ, নাকি আর্মির লোক, তা বলতে পারছি না। সকাল ৯টা, সাড়ে ৯টা কি ১০টা হবে। নাশতা রেডি করছিলাম। ‘সময় নেই, এখন যাই’ বলে নেমে গেল। নেমে গিয়ে আবার ফিরে এল। হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে এসে বলল, ‘আমার তো গাড়িতে পেট্রল নাই, পকেটে টাকা নাই। টাকা দাও।’ চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম, পায়ের মোজাটা চার–পাঁচ দিন ধরে পরছ, এটা চেঞ্জ করো। জহির বলল, ‘পরে ফেলছি যেহেতু এখন চেঞ্জ করার সময় নাই। আমি ফিরে এলে তুমি ধুয়ে দিয়ো।’ বলেই টাকা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

প্রথম আলো :

আপনার সঙ্গে জহির রায়হানের শেষ কথাটা কী হয়েছিল?

‘আমার তো গাড়িতে পেট্রল নাই। পকেটে টাকা নাই, টাকা দাও।’ এটাই আমাদের শেষ কথা।

প্রথম আলো :

জহির রায়হানের ওভাবে বের হয়ে যাওয়াটা শেষ যাওয়া হবে ভেবেছিলেন?

বাসা থেকে বের হওয়ার পর দুপুরের দিকে বাসার ল্যান্ডফোনে একটা ফোন এল। জানা গেল, এফডিসি থেকে সেই ফোন এসেছে। জহির রায়হানকে খুঁজছিল। যখন বলা হলো, জহির রায়হান সাহেব নেই। তখন বলল, ‘তাহলে ম্যাডামকে একটু দেন।’ তখন আমি কথা বললাম। কে যে কথা বলছিল, মনে নেই। আমাকে বলা হলো, ‘বোম্বে থেকে কিছু শিল্পীসহ কলাকুশলীরা এসেছেন। এফডিসিতে বিকেলে একটা অনুষ্ঠান আছে। জহির রায়হান ভাই যেহেতু নাই, আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে।’ বাসার সবাইও বলছিল, জহির যেহেতু যেতে পারবে না, আমাকে যেতে। আমি গেলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি, সবাই চুপচাপ, নীরব, নিস্তব্ধ। বললাম, সবাই এত চুপচাপ কেন? জহির কোথায়? শাহরিয়ার কবির বলল, ‘মেজদা এখনো আসেননি।’

প্রথম আলো:

এরপর কী করলেন?

শুনেছিলাম জহিরকে মিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ফোন করলাম সেখানে। ওপাশ থেকে কে ধরলেন, বলতে পারলাম না। শুধু জানতে চাইলাম, আমি জহির রায়হান সাহেবের স্ত্রী বলছি। তার তো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। তাকে কি একটু দেওয়া যাবে? কথা বলতে চাই। আমাকে বলা হলো, ‘তাকে এখন দেওয়া যাবে না।’ বলেই ফোনটা রেখে দিল। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন করলাম। এবার বলল, ‘আমরা সবাই ব্যস্ত। জহির রায়হান সাহেবকে এখন ফোন দেওয়া যাবে না।’ এবার এই কথা বলে ফোন রেখে দিল। একটু পর আবার ফোন দিলাম। তখন বলল, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এখানে গোলাগুলি হয়েছে। জহির রায়হান সাহেবকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তখন সম্ভবত রাত ৯টা হবে। আমার সমস্ত শক্তি কমে যাচ্ছিল। রাত পার হলো। দিন যাচ্ছে। জহিরের কোনো খবর পাচ্ছি না। এর মধ্যে খবর পেলাম, মিরপুরে গোলাগুলি হয়েছে। কিছু লোক মারা গেছে। এভাবে ৭ দিন, ১০ দিন পার। আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না, জহির গোলাগুলিতে মরতে পারে বা স্বাধীন দেশে জহির হারিয়ে যেতে পারে! এরপর পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলে জহিরের ছোট ভাই জাকারিয়া হাবিবকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ওখানে তাঁবু টানানো ছিল। দেখা হলো একজন আর্মি পারসনের সঙ্গে, যত দূর মনে পড়ছে, তাঁর নাম মেজর মঈন। তিনি বললেন, ‘আমরা মিরপুরের ওখানে ছিলাম। ওখানে গোলাগুলি হয়েছে। তার পর থেকে জহির রায়হান সাহেবকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ আমার চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এরপর বাসায় চলে এলাম। সবাই মিলে কয় দিন পর মিরপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পুলিশের সহযোগিতা চাইলাম। তখনো মনের মধ্যে আশা আছে। মন বলছিল, জহিরকে নিশ্চয় পাব। আমরা গেলাম মিরপুর থানায়। পুলিশ দুজন বিহারিকে ধরে আনল। আমাদের সামনে চড়থাপ্পড় মারল। তারা বলল, সেদিন বিহারিদের সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছিল। অনেক মানুষ মারা যায়। পুলিশ তাদের নিয়েই ঘটনাস্থলে গেল। কয়েকটি কলাগাছের আশপাশের মাটি খোঁড়া হয়। অনেকগুলো মৃতদেহ দেখাল। এরপর পুলিশ একটি কুয়ার কাছে নিয়ে গেল। মৃতদেহে ভর্তি ছিল। ভয় পেলাম। বিয়ের সময় আমি জহিরকে ওমেগা ঘড়ি উপহার দিয়েছিলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার দেওয়া কার্ডিগ্যান পরনে ছিল। ভেবেছিলাম, ওসব দেখলেও তো অবশ্যই চিনব। কিন্তু কোথাও জহির রায়হানকে খুঁজে পেলাম না।

প্রথম আলো:

এরপর আশা কি ছেড়ে দিয়েছিলেন?

পরিবারের সবাই মিলে খুঁজছি। সবার মন খারাপ। বাসায় এসে বসে থাকি, শুয়ে থাকি। কান পেতে থাকতাম, জহির কখন আসবে। জহিরের একটা অভ্যাস ছিল, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠত, দৌড়ে নামত। জুতার আওয়াজ কানে আসত। আমাদের রুমটা ছিল সিঁড়ির সঙ্গে। দোতলায় থাকতাম। ভাবতাম, এই বুঝি জহিরের পায়ের জুতার শব্দটা পাব।

জহির রায়হান ও সুচন্দা
সুচন্দার সৌজন্যে

প্রথম আলো :

কবে নিশ্চিত হলেন, জহির রায়হানের খোঁজ আর পাবেন না?

এক মাস পার হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে যাই, আর বুঝি জহিরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।