গান আমাকে কখনো একা হতে দেয়নি

দুপুরে ফোনে তাঁকে পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পর ফোন ধরলেন। আশপাশে তখন বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। বললেন, ‘শিল্পকলা একাডেমিতে মহড়ায় আছি, চলে আসো।’ সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির মহড়াকক্ষের বাইরে থেকে ভেসে আসছিল তবলা, হারমোনিয়াম, কি–বোর্ড, গিটার আর বেহালার সম্মিলিত সুর। বাদ্যযন্ত্রীরা বাজাচ্ছেন আর সবার মধ্যমণি হয়ে আছেন সাবিনা ইয়াসমীন। বাদ্যযন্ত্রের তালে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী। প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। দেশে–বিদেশে কত অনুষ্ঠানে কতবার গেয়েছেন অথচ এখনো মহড়ায় কী নিষ্ঠা! কত একাগ্রতা! অপেক্ষার পর একটু বিরতি মিলল। হাসিমুখে জানালেন, ‘৭ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে গান থাকবে। সকাল থেকে মহড়ায় আছি। আসলে যেকোনো অনুষ্ঠানের আগে এখনো নিয়মিত মহড়া করি।’ সাবিনা ইয়াসমীনকে খুঁজে বের করার কারণ তাঁর জন্মদিন। আজ ৪ সেপ্টেম্বর, এই দিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন এই শিল্পী। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গান করছেন সাবিনা ইয়াসমীন। ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের প্রযোজনায় ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রথম প্লেব্যাক। তারও আগে ‘নতুন সুর’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে গান করেছিলেন। এরপর হাজারো গান, লাখো ভক্ত, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অগণিত স্বীকৃতি। তবু জন্মদিনে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় আয়োজন গান। এই জন্মদিনে তাঁকে ঘিরে চ্যানেল আই তৈরি করেছে বিশেষ ডকুফিল্ম—‘জুঁই ফুল: সাবিনা ইয়াসমীন’। নির্মাণ করেছেন শাইখ সিরাজ। শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা ভবনের মহড়াকক্ষে বুধবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে জীবনের নানা দিক নিয়ে আলাপে মেতে উঠলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমীন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

‘জুঁই ফুল’–এ আপনার কোন জীবনটা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে—গানের জীবন নাকি ব্যক্তিগত জীবন?

সাবিনা ইয়াসমীন : আমার পুরো জীবনটাই তো গানের। পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন বলতে আলাদা কিছুই নেই—সব একাকার হয়ে গেছে। এই ডকুফিল্মে আমার লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা, গান শেখা, গানের জগতে আসা—সবই আছে। দুই ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের একটা অনুষ্ঠানে যেভাবে দীর্ঘ জীবনের যতটা তুলে আনা যায় আরকি।

দেশাত্মবোধক গান নিয়ে হাজির হবেন সাবিনা ইয়াসমীন
ছবি: ইত্যাদির সৌজন্যে

প্রথম আলো :

ফিল্মটি কি আপনার দেখা হয়েছে?

সাবিনা ইয়াসমীন : পুরোটা দেখতে পারিনি। ১০ মিনিট দেখেছি। শাইখ সিরাজ খুব গবেষণা করে কাজ করেন, এই ডকুফিল্মের কিছুটা দেখে তাই মনে হয়েছে। বোঝা গেছে, তিনি খুব পরিশ্রম করেছেন। এর বাইরে তিনি জন্মদিন উপলক্ষে তারকাকথন নামে একটি অনুষ্ঠানও করেছেন, সেটাও এত সুন্দরভাবে, পুরো ব্যাপারটা করেছেন, যা একেবারে আলাদা—খুবই উপভোগ্য, অসাধারণ।

সাবিনা ইয়াসমীন
প্রথম আলো:

জনপ্রিয়তার আড়ালে মানুষ হিসেবে আপনি কতটা ভিন্ন?

সাবিনা ইয়াসমীন : মানুষ এবং শিল্পী হিসেবে কোনো ভিন্ন বোধ করি না। আমি সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ। আগেই বলছি, আমার দুটো জীবনই গানে গানে একাকার হয়ে গেছে।

প্রথম আলো :

এই জীবনে এমন কোনো সম্পর্ক বা মানুষ আছে, যিনি আপনার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী?

সাবিনা ইয়াসমীন : আলাদাভাবে তেমন কিছু বা কেউ কখনো ছিল না। আমার জীবনের সঙ্গে অনেকে ছিলেন—এই যেমন আমার ওস্তাদেরা, আমার পরিবার, যাঁরা সব সময় আমাকে গানের জীবন এগিয়ে নিতে শক্তি–সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এত কিছু শিখলাম, এত দূর আসলাম—সবই তাঁদের সবার কাছ থেকে।

প্রথম আলো :

জীবনের কোন মুহূর্তগুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছে?

সাবিনা ইয়াসমীন : সত্যি বলতে আমার সংগীতজীবনে কঠিন মুহূর্ত আসেনি। আল্লাহর রহমতে খুব ভালোভাবে এত দূর পর্যন্ত এসেছি, এতটা পথ কাটিয়েছি। তবে মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কঠিন মুহূর্ত যে আসেনি, তা নয়। ওই সময়টায় গানই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গান আমার আনন্দ, দুঃখ, জীবন—সব।

সাবিনা ইয়াসমীন ও তাঁর মেয়ে বাঁধন
ছবি : সংগৃহীত
প্রথম আলো:

কখনো কখনো জীবনে আসে একাকিত্ব বা সংকট। জীবনের এমন মুহূর্তে কোন জিনিসে ভরসা করেছেন—গান, পরিবার নাকি অন্য কিছু?

সাবিনা ইয়াসমীন : ও রকমভাবে আমাকে কখনো একাকিত্ব পেয়ে বসেনি। গান আমাকে কখনো একা হতে দেয়নি। গানই আমাকে সব সময় সঙ্গ দিয়েছে। গানকে সঙ্গী করে জীবনের সব পর্যায়ে ভালোই ছিলাম। সবাই আমার আশপাশে ছিল—গান, পরিবার, আমার সমস্ত মানুষ, দর্শক–শ্রোতা। দর্শক–শ্রোতার ভালোবাসা তো সবচেয়ে বিশাল শক্তি, সাহস ও প্রেরণা। আশা করি আগামী দিনগুলোতে তাঁরা সবাই থাকবেন।

প্রথম আলো :

বছর ঘুরে জন্মদিন আসে, চলে যায়। কেমন লাগে?

সাবিনা ইয়াসমীন : ভালোই তো। বেশ লাগে এই দিনে। আজও (জন্মদিনের আগের দিন শিল্পকলায়) মহড়ায় এসে কেউ ফুল দিচ্ছে, কেক কাটছে—এসব তো সুন্দর। আরেক দিকে মনে হয়, আসল গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সত্যি বলতে, মিশ্র একটা অনুভূতি। একদিকে খুশি, আরেক দিকে চিন্তা। এখন তো মনে হয়, যতটা পেরিয়ে এলাম, তার অর্ধেকের অর্ধেকও তো থাকব না—যদিও এটাই দুনিয়ার নিয়ম।

‘জুঁই ফুল’- ডকুফিল্মের একটি দৃশ্যে সাবিনা ইয়াসমিন ও শাইখ সিরাজ
ছবি : চ্যানেল আইয়ের সৌজন্যে
প্রথম আলো:

ফেলে আসা জীবন বা শৈশবের জন্মদিনের কথা মনে পড়ে?

সাবিনা ইয়াসমীন : ফেলে আসা দিনের জন্মদিন তো খুব মধুর। বিশেষ করে একদম ছোটবেলার এবং স্টুডেন্ট লাইফের, এর কিছুদিন পরেও বড়সড় আয়োজনে জন্মদিন উদ্‌যাপন করতাম। বাসায় অনেক লোকজনও আসতেন। খুব ভালো লাগত।

প্রথম আলো :

গানে আপনার দুই সন্তানের কাউকে সেভাবে পাওয়া যায়নি।

সাবিনা ইয়াসমীন : এটা ওদেরই পছন্দ। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কিছুই ছিল না। ছেলেমেয়েদের ওদের ইচ্ছার ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেয়ে (ইয়াসমীন ফাইরুজ বাঁধন) এখন ব্যাংকে ভালো চাকরি করছে। এটাতে সে-ও খুশি, আমিও খুশি। আর ছেলে (রাফি হোসেন) তো লন্ডনে পড়াশোনা শেষে চাকরি  করছে। আমি বেশির ভাগ সময় দেখেছি, বাবা-মায়েরা যে পেশায় থাকেন, ছেলেমেয়েরা সেই পেশায় খুব একটা আসে না। এলেও মা-বাবার মতো অতটা সাফল্য সাধারণত খুব একটা পায় না।