ছেলেদের টার্গেট করে এমন চটুল গান হয়নি, বললেন ‘ভাল্লাগে’ গানের সুমী
‘ভাল্লাগে’ গানটি দিয়ে ইউটিউব, টিকটকে রীতিমতো ভাইরাল সুমী শবনম। তাঁর সংগীতজীবনের গল্প শুনল ‘বিনোদন’
প্রশ্ন :
‘ভাল্লাগে’ দেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে।
গানটি যে এই পর্যায়ে যাবে, এমন কোনো প্রত্যাশাই ছিল না। গানটি নিয়ে মজার ঘটনা আছে। লেখা হয় প্রায় পাঁচ বছর আগে। এটি আমার স্বামী আকরাম হোসেনের লেখা। যে ডায়েরিতে গানটি লেখা হয়েছিল, সেটি হারিয়ে গেছে। তবে বছর দুয়েক আগে দুজন মিউজিশিয়ানকে গানটি পাঠিয়েছিলাম। তাঁদের একজনের কাছ থেকে খুঁজে পেয়েছি। তখন গানটি আর করিনি। কিছুদিন আগে আমার স্বামী বললেন, ‘যেহেতু তোমার ইউটিউব চ্যানেল আছে, ফেসবুক পেজ আছে, গানটি করে ছেড়ে দাও।’ সংগীতায়োজনের জন্য নয়ন দাসের কাছে গিয়ে চার-পাঁচটি গান শোনালাম। এই গানই পছন্দ করলেন তিনি। এরপর গানটি করে আরও তিন মাস ফেলে রেখেছিলাম। হঠাৎ গত কোরবানির ঈদের দুই সপ্তাহ আগে নয়ন ফোন করে বললেন, ‘আপা, গানটি করে তো ফেলে রাখলেন। একটা জায়গায় গানটি শুনিয়েছি, তাদের পছন্দ হয়েছে।’ গানটি তাদের দিয়ে দিতে বললাম। এরপর তো মিউজিক ভিডিও হলো। ঈদে প্রকাশ পেল। তারপর তো ইতিহাস।
প্রশ্ন :
গানটি দর্শক-শ্রোতাদের কাছে ভালো লাগার কারণ কী?
গতানুগতিক ধারার বাইরে হওয়ার কারণে গানটি সবার পছন্দ হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের কাছে। গানটির সুরের কিছু অংশ সংগৃহীত। সুর কিছুটা পরিচিত, কথাগুলোও মজার। এসব কারণে এখনকার ছেলেমেয়েদের মনে ধরেছে। দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েদের নিয়ে গান হয়েছে। কিন্তু ছেলেদের টার্গেট করে এমন চটুল গান হয়নি। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত—সব শ্রেণির তরুণদের কাছে পৌঁছেছে গানটি। নির্দিষ্ট চ্যানেলে এই গানের ভিউ প্রায় ৩৭ মিলিয়ন। তা ছাড়া অসংখ্য ভুয়া চ্যানেলে তো আছেই। দেশ-বিদেশে গানটির টিকটক হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। টিকটকেই গানটির বেশি রেকর্ড হয়েছে।
প্রশ্ন :
যখন গানটি করেছিলেন, তখন কি মনে হয়েছিল এভাবে ছড়িয়ে পড়বে এটি?
আমার তেমন আস্থা ছিল না। তবে নয়ন দাসের ছিল। গানটি করার আগে নয়নকে বলেছিলাম, মা হওয়ার কারণে মধ্যে দীর্ঘ সময় গান করিনি। এমন একটি গান আমাকে করতে হবে, যাতে সবার হৃদয়ে গেঁথে যায়। কারণ, গানের খরা চলছে। অনেকেই গান করছেন, তাঁদের গান ভিউও হচ্ছে, কিন্তু দর্শকের হৃদয়ে স্থান পাচ্ছে না। শিল্পীরা তাঁদের নিজের গাওয়া গান নিজেই স্টেজে গাইতে পারেন না। অন্যের গান করতে হয়।
প্রশ্ন :
এখন তো নতুন করে আপনাকে সবাই চিনছেন, জানছেন...
২০০১ সালে ‘একটা চশমা কিনে দে’ শিরোনামে গানটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে ললিতা ধারাবাহিক নাটকের ‘ললিতা’ গানটিও শ্রোতারা পছন্দ করেছিলেন। তবে গানটি বেশি পরিচিতি দিয়েছে। এই গানের কারণে শ্রোতা-দর্শকেরা আমার আগের করা পুরোনো অনেক গান নতুন করে শুনছেন, ভিউও বাড়ছে গানগুলোর। দেশ-বিদেশে গাইতে ডাক আসছে।
প্রশ্ন :
গানটি ভাইরাল হওয়ার পর কাজ বেড়েছে?
অনেক বেড়েছে। মঞ্চ, টেলিভিশন, রেডিওতে প্রচুর কাজ করছি। ১৬ ডিসেম্বর থেকে টানা স্টেজ শো করছি। ভারতেও স্টেজ শোর ডাক পড়েছে। জানুয়ারি মাসে কলকাতায় তিনটি শো চূড়ান্ত হয়েছে। তা ছাড়া আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় থেকেও এ গানের সাড়া পাচ্ছি। ভারতের সিরিয়ালের নায়িকাও দেখি এটি নিয়ে টিকটক করেন। গত পূজায় আমার গানটি ভারত ও বাংলাদেশের পূজামণ্ডপগুলোতে ব্যাপকভাবে বেজেছে। সেখানকার স্থানীয় শিল্পীরা মঞ্চে গেয়েছেন।
প্রশ্ন :
এখন আর কী কী কাজ করছেন?
সামনে একটি অডিও-ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আমার পাঁচটি গান আসবে। বেশির ভাগই ফোক ঘরানার। ‘ভাল্লাগের’ কথা মাথায় রেখেই গানগুলো করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখান থেকে কয়েকটি গান শ্রোতাদের মনে ধরবে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি অডিও-ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে গান করার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তুতি নিচ্ছি।
প্রশ্ন :
কী হতে চেয়েছিলেন, কী হলেন?
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার মহেশপুর গ্রাম থেকে আমার মতো মেয়ে কী স্বপ্ন দেখতে পারে, আপনারাই বলুন। তবে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, তখন আমার মনে বড় স্বপ্ন ছিল—ঢাকা যাব, গান করব। সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, জানতাম না। ২০০১ সালে আমার বড় ভাই ঢাকায় নিয়ে এলেন। এসেই একটি অ্যালবাম করার সুযোগ পেলাম। ‘একটা চশমা কিনে দে’ শিরোনামে ১২টি গান নিয়ে অ্যালবাম করলাম। ‘একটা চশমা কিনে দে’ গানটি সে সময় ভালোই সাড়া ফেলেছিল। ঢাকায় আসার স্বপ্নও পূরণ হলো, গান গাওয়ারও স্বপ্ন পূরণ হলো।
প্রশ্ন :
ফোক গান দিয়ে পরিচিতি। অন্য ঘরানার গান পছন্দ হয়?
রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করি। রবীন্দ্রনাথের গান যখন শুনি, মনে হয় এর চাইতে সুন্দর গান আর পৃথিবীতে নেই। আমি বাসায় বসে রবীন্দ্রনাথের গান করি। বাসায় অতিথিরা এলে রবীন্দ্রনাথের গান শোনাই। ভালো লাগে। কিন্তু আমার গলা তো ফোক গানের। আমাকে দিয়ে হাজারো চেষ্টা করালেও তো আধুনিক গান শ্রুতিমধুর হবে না।
প্রশ্ন :
কখন গান গাওয়া শুরু?
মহেশপুর গ্রাম থেকে শুরু। বাবা গান করতেন। তিন ভাইও করেন। স্কুল-কলেজ গ্রামেই কেটেছে। পরিবারের সবার মধ্যে গানের চর্চা থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই গ্রামে আমার গানের হাতেখড়ি। লালন দিয়েই আমার গানের চর্চা শুরু। ছোটবেলায় ফরিদা পারভীনের গান খুব টানত। গ্রামে থাকার কারণে জাতীয় পর্যায়ে এসে গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি তখন। তবে উপজেলা-জেলা পর্যায়ে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। অনেক পুরস্কার, সনদে ভরা আমার বাড়ির বাক্স। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, ওই এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ত। আমার মনে আছে, বড় ভাই আমাকে হাত ধরে অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন।