ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ দেখি কোচিংয়ের সেই ছেলেটা: মৌসুমী

মৌসুমী
১৯৯৩ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সোহানুর রহমান সোহানের এই ছবির মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা পেয়েছিলেন দুটি নতুন মুখ—মৌসুমী ও সালমান শাহ। প্রথম ছবিতেই তাঁরা বাজিমাত করেন—অভিনয় দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেন। ২৬ বছর আগে সালমান শাহ মারা যান। ছবির ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সাক্ষাৎকারে এই ছবি নিয়ে মৌসুমী মেলে ধরলেন অজানা গল্প। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—

প্রশ্ন :

৩০ বছর পার করলেন। যখন পেছন ফিরে তাকান কী অনুভূতি হয়?

অনেকের অনেক টাকাপয়সা থাকে, কিন্তু স্বার্থহীন ভালোবাসা পায় না। জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে মানুষ যেভাবে ভালোবাসা জানায়, এ ধরনের অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা হয় না। এসব অনুভূতিই শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে অনুপ্রেরণা।

মৌসুমী
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’–এর রিমেক হলেও ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ বাংলা চলচ্চিত্রে একটি বাঁকবদলের নাম। এই ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবটা আপনার কাছে কীভাবে এসেছিল?

ওই সময় আমার ছবির প্রস্তাবগুলো আসত গুলজার (পরিচালক মুশফিকুর রহমান) ভাইয়ের মাধ্যমে, তখন তিনি সাংবাদিকতা করতেন। সাক্ষাৎকার নিতে একদিন ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরে হুমায়ূন রোডের বাসায় এসেছিলেন, সঙ্গে ভাই–বন্ধু হয়ে এসেছিলেন সোহান ভাই। চলচ্চিত্রে আগ্রহী কি না, কৌশলে জানতে চান। তখন আমি মডেলিং করি। মধ্যবিত্ত পরিবার, তাই নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করিনি। গুলজার ভাই বললেন, ‘ধরুন, হিন্দি ছবি “কেয়ামত সে কেয়ামত তক” যদি বাংলায় রিমেক হয়, আপনি জুহি চাওলার চরিত্রটা করবেন, আমির খানের চরিত্রে নোবেল, তৌকীর আহমেদ কিংবা জাহিদ হাসানও হতে পারেন।’ তাঁরা জানতেন, তৌকীর ভাই আর নোবেল ভাইয়ের ভক্ত আমি। তখন কিছুটা আগ্রহী হলাম। কারণ, সহশিল্পী হিসেবে পছন্দের শিল্পীরা থাকবেন। এরপর স্বপ্ন দেখা শুরু করি। কীভাবে বাসায় বলা যায়, উপায় খুঁজি। এরপর আরও অনেক ছবির প্রস্তাব পেয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বাছাই করতে থাকি, কার ছবি করব? ঘুরেফিরে দেখি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।

প্রশ্ন :

প্রথম দিন ক্যামেরার সামনে দেওয়া সংলাপ কী ছিল?

প্রথম দিন সংলাপ দেওয়া হয়নি। সেদিন ক্যামেরার সামনে ভয়ে কাঁপছিলাম। একটি দৃশ্য ছিল, ওই দিন একটা বাইকে সালমান আর আমি এফডিসি থেকে কাঁচপুর গেছি। আবার ফিরে আসি। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ধারণ প্রথম দিন করা হয়।

মৌসুমী
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

সালমান শাহর সঙ্গে তো আপনার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল...

তখন আমরা খুলনায় থাকতাম। ছোটবেলায় ইমন (সালমান শাহ) আর আমি প্লে গ্রুপ ও নার্সারিতে একসঙ্গে পড়েছি। বাবার চাকরির কারণে ইমনের পরিবার খুলনা সার্কিট হাউসে থাকত। ওই স্কুলে আমার ফুফু ছিলেন টিচার। ফুফুর ছুটি হওয়া পর্যন্ত ইমনদের বাসায় আড্ডা দিতাম। সে–ও আমাদের বাসায় যাওয়া-আসা করত। ভালো বন্ধুত্ব হয়। এরপর হঠাৎ ওরা ঢাকায় চলে আসে।

পোস্টারে মৌসুমী ও সালমান
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম চলচ্চিত্রের সহশিল্পী ছোটবেলার বন্ধু, ব্যাপারটি কেমন ছিল?

বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তা ছবিটি করতে গিয়ে নতুন করে টের পাই। ছবির কাজ করার সময় আমাদের দেখা হয়। আবেগাপ্লুত হলাম। অল্প কদিনেই আমাদের সম্পর্ক আবার আগের রূপ নেয়। নিজেদের সবকিছুই একজন আরেকজনকে বলতাম। আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে তো পরিচালক সোহান ভাই ভুল বুঝতেও শুরু করেন। তিনি ভাবলেন, আমরা একজোট হয়ে গেছি।

প্রশ্ন :

কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবি উপলক্ষে আপনাদের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল?

নব্বই দশকে ম্যাকডোনাল্ড চায়নিজ নামে ধানমন্ডিতে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। পরিচালক সোহান ভাইসহ অপেক্ষা করছি। ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ দেখি কোচিংয়ের সেই ছেলেটা। এভাবে একজন লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি কী ভাববে, ভেবে আমি মুখটা লুকাই। দেখলাম, ও আর সামনে আসছে না। সে হয়তো ভাবছিল, আমিও সন্দেহ করছি। আর আমি ভাবলাম, ও কারও সঙ্গে ডেট করতে এসেছে। সোহান ভাইয়ের তো মাথায় টাক। একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে আমি কেন এখানে—এ প্রশ্ন সে মনে মনে ভাবতেই পারে। এমন সময় সোহান ভাইকে বললাম, কই আপনার হিরো? এই ছেলেটা আপনার হিরো নাকি? ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এই ইমন (হাসি)। এ যেন বাস্তবেও চলচ্চিত্র। (হাসি)

সালমান শাহ ও মৌসুমী

প্রশ্ন :

জীবনের প্রথম সিনেমা এত সাড়া ফেলবে ভেবেছিলেন?

এটা যে প্রেমের আদর্শ গল্প হয়ে যাবে, এই জুটি যে প্রেমের আদর্শ জুটি হবে, প্রিয় জুটি হয়ে উঠবে, ভাবিনি। এত বড় স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে না। যখন পেছনে ফিরে তাকাই দেখা যায়, এই স্বপ্নটা যদি দেখতাম, তাহলে স্বপ্ন দেখেই মারা যেতাম। ৩০ বছর সমানতালে জনপ্রিয় থাকবে একটা ছবি, আমাকে ‘কেয়ামত–কন্যা’ ডাকবে! এখনো সালমান মানে আমি, আমি মানে সালমান যে ভাববে অথবা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির প্রতিটি গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্পর্শ করবে—এসব ভাবার মতো শক্তি আল্লাহ দেননি। এটা আল্লাহর দান। এটা মানুষ কখনো সৃষ্টি করতে পারে না।

প্রশ্ন :

৩০ বছরে দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কোন ছবিগুলো আপনার কাছে বিশেষ?

কোনো ছবি আমাকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে, মানুষের মনের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। দেখা গেছে, এসব ছবি আমি কখনোই করতে চাইনি, কিন্তু দর্শকপ্রিয়তা ঠিকই পেয়েছে। তার মধ্যে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘লুটতরাজ’—এগুলো মাইলফলক। আমি হয়তো যেটা খুব পছন্দ নিয়ে করেছি, কিছু মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কিছু হিট আছে, সুপারহিট আছে, কিছু ফ্লপ হয়েছে—এ রকম অনেক ছবি আমার ভালো লেগেছে। আমার এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই, নেই কোনো আকাঙ্ক্ষাও। এসব নিয়ে ভাবলে আফসোস বেশি হয়। যেটা পারিনি, সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। যা পেয়েছি, সেটা তো অনেকেই পায়নি।

ওমর সানী ও মৌসুমী
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

৩০ বছরে অনেকের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কাকে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন?

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তাকেই মনে হয়েছে, যাকে আমার জীবনসঙ্গী করেছি। একজন পুরুষ হিসেবে আজ পর্যন্ত তাঁর মধ্যে কোনো ঝামেলা পাইনি।

প্রশ্ন :

ওমর সানী ছাড়া পেশাগত ক্ষেত্রে কে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য?

আমার স্বামী ছাড়া যদি একজনের কথা বলি, তিনি মান্না ভাই। শুধু সহশিল্পী নন, আমার একজন ভালো পরামর্শকও ছিলেন।