পেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কিন্তু আমার অ্যালার্জি নেই

দুই সিরিজ ‘শাটিকাপ’ আর ‘সিনপাট’-এর পর প্রথম সিনেমা ‘দেলুপি’ দিয়ে আলোচনায় মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। সাম্প্রতিক কাজ, নিজের সিনেমাদর্শনসহ নানা প্রসঙ্গে গতকাল তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন লতিফুল হক

প্রথম আলো:

আপনার কাজের প্রক্রিয়া কী? আপনি গল্প খোঁজেন, নাকি গল্পই আপনাকে খুঁজে বের করে?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : ‘দেলুপি’র গল্প খোঁজার গল্পটা একটু ভিন্ন। ২০২৪ সালে সারা দেশের অনেক জায়গার মতো খুলনার দেলুটি ইউনিয়নেও বন্যা হয়। আমরা শুধু এ ঘটনা জেনে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে গল্প খুঁজতে শুরু করি। আমরা যখন গেছি, তখনই পরিকল্পনা ছিল, ওখানে ফিচার ফিল্ম বানাব। গেছি, গল্প খুঁজেছি; গল্প দাঁড় করিয়েছি। তারপর শুট করেছি। ‘দেলুপি’র গল্পটা আসলে আমাদের খুঁজে নিয়েছে, আমরা গল্পটাকে পিক করিনি। কারণ, আমরা ওই সময়ের বাস্তবতাটাকে অনুসরণ করেছিমাত্র।

‘দেলুপি’র দৃশ্য
ছবি: প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে

প্রথম আলো :

আপনার সব সিরিজ আর সিনেমার পটভূমি মফস্‌সল। স্থানীয় গল্প বলতে কেন পছন্দ করেন?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : আমি রাজশাহীতে বড় হয়েছি। নির্মাতা হিসেবে চলার শুরুও হয়েছে রাজশাহীতে। আমার এ ধরনের আঞ্চলিক গল্প, সাধারণ মানুষের গল্প বলতে খুবই ভালো লাগে; সত্যিকারের আনন্দ পাই। সেখান থেকে আসলে লোকাল গল্প নিয়ে কাজ করা। কিন্তু সব সময় যে এ ধরনের রিয়েলস্টিক অ্যাপ্রোচে স্থানীয় গল্প বলতে চাই, ব্যাপারটা এ রকমও নয়; আমি নানা ধরনের গল্প বলতে চাই।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো:

আপনি অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেন। বড় তারকাদেরও দেখা যায় না। এটা কি সচেতন সিদ্ধান্ত, নাকি গল্পের চাহিদা?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : এ পর্যন্ত যে তিনটা কাজ নিয়ে কথা হয়েছে (‘শাটিকাপ’, ‘সিনপাট’ ও ‘দেলুপি’), সেগুলোতে সবাইকে গল্পের প্রয়োজনেই নেওয়া। আমার নতুন মুখ দরকার ছিল, যাদের দেখে, ডায়ালেক্টে মনে হবে সব অর্থেই সেখানকারই মানুষ। আমার কাছে মনে হয়, প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে অভিনেতা। ঠিকঠাকমতো চরিত্রের জন্য প্রস্তুত করতে পারলে আর নিবেদন থাকলে যে কেউই ভালো চরিত্র হয়ে উঠতে পারে।

প্রথম আলো :

অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করা তো চ্যালেঞ্জেরও?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : অপেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কাজ করলে চ্যালেঞ্জ আছে, আবার নতুন সুযোগও আছে। নতুনেরা কাদামাটির মতো, তৈরি করে নেওয়া যায়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, যাঁরা সত্যিই অভিনয় করতে চান, তাঁদের সেই নিবেদনটা থাকে। এই প্রক্রিয়াটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। চরিত্রের সঙ্গে শিল্পীর আর শিল্পীর সঙ্গে নির্মাতার একটা শক্ত বন্ধন তৈরি হতে হয়। সব শিল্পীর সঙ্গে আমার একটা সংযোগ তৈরি হয়, দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বুঝতে চেষ্টা করি; তারাও আমাকে বোঝার চেষ্টা করে। এভাবে তাদের নিয়ে পরিচালনা করাটা খুব সহজ হয়ে যায়। তাদের আবেগ বোঝা, সেই চরিত্রের জন্য কতটা জার্নি আমাদের কীভাবে করতে হবে, কীভাবে করলে আমরা একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারব—পুরো প্রক্রিয়াই খুব ইন্টারেস্টিং।

‘শাটিকাপ’–এর দৃশ্য। ছবি : চরকির সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আব্বাস কিয়ারোস্তামিসহ অনেক নির্মাতাই অপেশাদারদের নিয়ে কাজ করতেন। আপনার পছন্দের নির্মাতা কে?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : পছন্দের নির্মাতা আসলে অনেকেই, কিন্তু আমি একজনের নামই বারবার বলি। ঋত্বিককুমার ঘটক। ভেতরে একটা নির্মাতাসত্তা তৈরি করতে তাঁর কাজ আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছে। উনিও রাজশাহীতে থেকেছেন। তাঁর মতো আমিও কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, এটা আমাকে অন্য রকম একটা শক্তি জুগিয়েছে। মনে হয়েছে, এটা ঋত্বিককুমার ঘটকের মাটি, এই আবহাওয়াতেই বড় হয়েছেন, তিনি আমার স্কুলে বড় ভাই—এটা ছিল বড় প্রেরণা।

‘সিনপাট’–এর দৃশ্য। চরকি

প্রথম আলো :

‘দেলুপি’তে যাত্রাপালা, স্থানীয় শিল্পীদের সমস্যা উঠে এসেছে, যা দেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। এই সময়, রাজনীতি—এসব আপনার কাজকে কীভাবে প্রভাবিত করে?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : আমি তো আসলে সময়টাই ধরতে চেয়েছি। গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়, এই বন্যা, আমাদের সাংস্কৃতিক অবস্থা আসলে ওই গ্রামই (দেলুটি) প্রতিনিধিত্ব করছিল। আমি শুধু গল্পের সঙ্গে এগিয়েছি, এভাবে ছবিতে সবই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে; এ জন্য আমাদের আলাদাভাবে খুব কোনো কিছু করতে হয়নি। আমরা কিছু আলাদাভাবে পুশ করতে চাইনি; জাজমেন্টাল না হয়ে সময়টাকে–পরিস্থিতিটাকে যেন সরলভাবে বলা যায়; সে চেষ্টাই করেছি। রাজনীতি, সংস্কৃতির সঙ্গে ওই সময়ে গণমানুষের একটা প্রেম—সবই কিন্তু এসেছে সিনেমায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবতাকে আমরা ফিকশন হিসেবে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে পেরেছি।

প্রথম আলো:

বড় তারকা নেই, স্থানীয় গল্প—সব অর্থেই ব্যবসার বিচারে‘দেলুপি’ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ সিনেমা...

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : আমি এই মডিউল নিয়ে খুবই আশাবাদী। মডিউলটা নিয়ে নানা জায়গায় কাজ হচ্ছে। শুধু যে আমরাই করছি, তা নয়। এটা আগেও নানাভাবে হয়েছে। আমার মনে হয়, এই প্রক্রিয়া এভাবে চলমান থাকলে আরও জনপ্রিয় হবে। একটা সময় হয়তো বিশ্ব চলচ্চিত্রেও জায়গা করে নেবে।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ফেসবুক থেকে

প্রথম আলো :

আপনার সব কাজে পর্দায় একটা ধূসর আবহ থাকে...

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : আমার সব কাজেই এই ধূসর ব্যাপারটা ছিল। সে কারণেই আমি ছবির মেজাজ, কস্টিউম, কালার, সেটে সেই আবহটা রাখতে চেয়েছি। এটা আসলে সিনেমার মেজাজের ওপর নির্ভর করে; সিনেমায় দর্শকদের কী অনুভূতি দিতে চাই, সেটার ওপর নির্ভর করে।

‘দেলুপি’ সিনেমার দৃশ্য
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আপনার কাজ দেখে মনে হয়, আপনি দর্শককে অস্বস্তিতে রাখতে চান...

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া আমার তিনটা কাজে সত্যিই অস্থিরতা আছে। গল্পের কারণেই আছে। এটা ইচ্ছাকৃত নয়, গল্পের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো :

কোনো বড় প্রযোজনা সংস্থা বড় তারকাদের নিয়ে পুরোপুরি বাণিজ্যিক কাজ করতে বললে রাজি হবেন?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : পেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কিন্তু আমার অ্যালার্জি নেই। আমি নিজেও নানা ধরনের শিল্পী নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখি। মনে হয়, গল্পের এই চরিত্রটা অমুক হলে খুব ভালো হতো। আরেকটু গুছিয়ে উঠলে যখন অন্য কাজগুলো আমরা শুরু করব, তখন কিন্তু ওই মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। বলব, এই কাজটা আমি আপনার সঙ্গে করতে চাই, আপনি আগ্রহী কি না? গল্প যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে। আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারি, অন্য কোনো প্রযোজনা সংস্থা আমাদের গল্প দিতে পারে। যেটার প্রেমে পড়ব, সেটাই বানাব। প্রেমে পড়াটা আসলে সবচেয়ে জরুরি।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ছবি: জাহিদুল করিম

প্রথম আলো :

পরের প্রকল্প কীভাবে ঠিক করেন? নাকি আবার বেরিয়ে পড়বেন গল্পের খোঁজে?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : ব্যাপারটা হচ্ছে প্রেমে পড়ার মতো। যে গল্পের প্রেমে পড়ব, আটকে যাব, সেটাই বানাব। আলাদাভাবে কোনো ডিজাইনের ব্যাপার থাকে না। অনেক গল্প নিয়েই কাজ করতে থাকি। কিছু গল্প আছে, যেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুত করতে হয়, লিখতে হয়, ডিজাইন করতে হয়। আবার কিছু গল্প, যেমন দেলুপির মতো সিনেমা, যেটা আসলে মনে হয়েছে এখনই বানিয়ে ফেলতে হবে।

প্রথম আলো:

অন্যান্য দেশে নির্মাতাদের তো সিনেমার প্রচার নিয়ে এতটা দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না। আপনি তো প্রচার নিয়ে খুব সক্রিয়। কোনটা কঠিন—সিনেমা বানানো, নাকি মুক্তির পর প্রচার?

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম : সিনেমা বানানোর চেয়ে সিনেমা মুক্তি দেওয়া বেশি কঠিন। আমরা যে ছবিটা বানিয়েছি, এই ছবিটাতে ওই ধরনের কোনো পরিচিত মুখ নেই, যাদের কথা মাথায় রেখে মানুষজন সিনেমাটা দেখতে আসবে। নির্মাতা হিসেবেও আমরা নতুন। মুক্তির আগে আমরা যখন চিন্তাভাবনা করছি, তখন দেখছি যে আসলে এই জায়গাগুলোতে গ্যাপ আছে। খুব ভালো প্রচারের টিম আমরা পাচ্ছি না, যারা কিনা এটা করতে পারে। আবার এটা স্বাধীনভাবে বানানো ছবি। আমাদের এত তহবিলও নেই। ফলে ঠিক করলাম, আমাদের ঢোল আমরাই বাজাই। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মানুষকে সিনেমার কথা বলা, এটা খুবই মজার একটা প্রক্রিয়া। অনলাইন, অফলাইনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এটা একই সঙ্গে অদ্ভুত আর মজার অভিজ্ঞতা।