আমার প্রেমিকারা ছাড়া কোনো পরিচালক এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি

নতুন সিরিজ নিয়ে আবার নির্মাণে ফিরছেন সুমন আনোয়ার। ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘চক্কর ৩০২’ ছবিতে অভিনয় করে আলোচিত তিনি। ঈদুল আজহার ছবিরও শুটিং করছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন সিনেমা নির্মাণেরও। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

‘মির্জা’ দিয়ে পরিচালনায় ফিরছেন। অভিনয়ে আপনি নিয়মিত হলেও নির্মাণে অনিয়মিত হয়ে পড়লেন কেন?

সুমন আনোয়ার : একটা সময় আমরা যেভাবে নির্মাণ করতাম টেলিভিশনে, সেই নির্মাণের গতি এখন আমাদের পক্ষে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, প্রতিনিয়ত নির্মাণের গুণগত মান উন্নত হচ্ছে। প্রোডাকশন কোয়ালিটি ঠিকঠাক রাখতে হলে বছরে একটা কিংবা দুইটার বেশি কাজ করতে পারব না। তাই আমাকে অভিনয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে যখন কাজ করি, তখন একটার প্রি-প্রোডাকশন চলতে থাকে বা আরেকটার মুক্তির প্রক্রিয়া বা অন্য কিছু হতে থাকে। যে রকম ‘মির্জা’ মুক্তি পাচ্ছে, এটার পেছনে এক বছর ধরে লেগেছিলাম। ওটিটি কনটেন্ট ও সিনেমার একই রকম কাজের ধারাবাহিকতা। সমপরিমাণ শ্রম দিতে হয়। চাইলে আগের মতো কাজের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব নয়।

প্রথম আলো :

সিরিজটি (মির্জা) নিয়ে বলুন...

২৩ মে এটি মুক্তি পাবে। দর্শকদের বলব, প্লিজ আগে দেখুন। আমরা বাংলাদেশি গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করতে যাচ্ছি, যেখানে মেধা এবং রসিকতার সমন্বয়ের একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, যার বয়স ৫০–এর বেশি, যে প্রার্থনা করছে, আমি যদি গোয়েন্দা হই, হতে চাই—তার শরীর ও শক্তি সামর্থ্য অন্য হিরো বা ফেলুদা বা শার্লক হোমসের মতো এতটা ক্ষিপ্র না কিন্তু তার মাথা কাজ করে। এ রকম একটা খুঁতসম্পন্ন গোয়েন্দা আমরা তৈরি করেছি। যার সঙ্গে গল্প আনফোল্ড হবে আবার অনেক বেশি আনন্দদায়ক ভ্রমণও হবে।

সুমন আনোয়ার
ছবি : সুমন আনোয়ারের ফেসবুক থেকে
প্রথম আলো:

এখন তো দেশ–বিদেশের প্রচুর গোয়েন্দা সিরিজ হচ্ছে। ‘মির্জা’য় আলাদা কী আছে?

সুমন আনোয়ার : আমরা যত গোয়েন্দা দেখেছি তারা উচ্চতায়, বয়সে, যৌবনে অনেক শক্তিশালী। আমার মির্জা ভেরি ওল্ড, ছোটখাটো মানুষ, মোটাসোটা মানুষ। খুব ভালো মারামারি করতে পারে না, দৌড়াতে পারে না। ভয় পায়, শঙ্কায় থাকে; কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক একজন গোয়েন্দার মধ্যে যে জিনিসটা কাজ করা দরকার, তা রয়েছে। তার অঙ্কের হিসাবটা দারুণ কাজ করে, ইনভেস্টিগেশন ভেরি বিউটিফুল।

প্রথম আলো :

কয়েক বছর ধরে আপনি ধারাবাহিকভাবে প্রচুর খল চরিত্রে অভিনয় করছেন। একঘেয়ে লাগে কি না?

সুমন আনোয়ার : গল্পকে যদি আমরা ব্যাখ্যা করতে চাই, ৫-৬টা ধারার বাইরে কিন্তু নাই। সারা পৃথিবীর গল্পই যদি দেখি, গল্পেরও যেমন সীমাবদ্ধতা আছে, চরিত্রেরও তেমন। ভালো–মন্দ, মাঝামাঝি, একটু বিসর্জন, একটু আগ্রাসী চরিত্র—এর বাইরে কিন্তু খুব একটা চরিত্র নেই। তা ছাড়া আমার চেহারা খারাপ, ঘুরেফিরে মানুষ তাই হয়তো আমাকে খারাপ চরিত্রে দেখতেই অভ্যস্ত। আমার চেহারা গুন্ডা টাইপের, কিন্তু আমি এত অদ্ভুত সুন্দর একজন প্রেমিক এবং ভালো মানুষ—যা আমার প্রেমিকারা ছাড়া কোনো পরিচালক এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি, এটা যদি শিগগির পরিচালকেরা আবিষ্কার করতে পারে, তাহলে আমাকে যেসব চরিত্রে দেখছেন, তার চেয়ে একদম উল্টো পিঠের চরিত্রে অদ্ভুত সুন্দর অভিনয় করতেও দেখবেন।

সুমন আনোয়ার
ছবি : সুমন আনোয়ারের ফেসবুক থেকে
প্রথম আলো:

কতজন প্রেমিকা আপনার আছে, গুনে শেষ করা যাবে তো?

সুমন আনোয়ার : (হাসি) প্রেমটা সুন্দর, অদ্ভুত। আমার কাছে প্রেমটা হচ্ছে শুটিংয়ের পড়ন্ত বিকেলে কোনো নদীর পাড়ে নির্জনে আমি শুটিং করছি, হয়তো ক্যামেরা এবং ইউনিট আমার থেকে অনেক দূরে—এই যে সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় বাতাস, প্রকৃতি, পানি, মাছ, পরিবেশ, আবহাওয়া—ওরাই আমার প্রেমিকা, সেই মুহূর্তের জন্য।

প্রথম আলো :

বিমূর্ত প্রেম ছেড়ে যদি বেরিয়ে আসতেন...

সুমন আনোয়ার : (হাসি) এটার হিসাব যদি দিই, তাহলে তো বাসা থেকে আবার ভীষণ চাপে পড়তে হবে। এই চাপ আর বাড়াতে চাই না। এখন শুধু ঘুরে বেড়ানো, পৃথিবী দেখার কাজটা করতে চাই। প্রেমটা আসলে খুব অল্প সময়ের জন্য ভালো। খুব বেশি সময় প্রেমকে টানা নতুন প্রেমের সম্ভাবনা ক্ষীণ করে দেয়। নতুন প্রেমের সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়া মানে নতুনভাবে পৃথিবী দেখার জানালা বন্ধ করে দেওয়া। দরজা-জানালা যতই খোলা রাখা যায়, পৃথিবী ততই আপনার জন্য সুন্দর হয়ে উঠবে।

সুমন আনোয়ার
চরকির সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আপনি নিজে নির্মাতা, অভিনয়ের সময় সেটে গেলে সেই সিনেমা বা সিরিজের নির্মাতাকে নিজের পর্যবেক্ষণ থাকলে বলেন নাকি অভিনেতা হয়েই থাকেন?

সুমন আনোয়ার : আমি অভিনেতা হয়েই থাকি। পরিচালক হিসেবে বিপদে পড়ে যাবে, এ রকম কোনো প্রোডাকশন নিয়ে আমি মিটিংই করি না, অভিনয় তো অনেক দূরের...। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, করছি—তারা যথেষ্ট দক্ষ। পরিচালক সত্তাকে আমি বাসায় রেখে অভিনয়ের জন্য শুটিংয়ে বের হই। শুটিংয়ে সেই সত্তাটাকে মনে করার চেষ্টা করি না, পরিচালক হলে কী করতাম বা কী হতো। আমি শুধু আনন্দ করতে যাই, অভিনয় করতে যাই। অন্যদিকে পরিচালক হিসেবে আমি যখন শুটিং সেটে থাকি, তখন সেই সময়টা কষ্টের যায়। টেনশনে সময় কাটে। ওই সময়ের বাইরে শুটিংকে যে অন্যভাবে অনুভব করা যায়, আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে উদ্‌যাপন করা যায়, সেটা শুধু শুটিংয়ে বোঝা যায়।

প্রথম আলো :

আপনার সমসাময়িক অনেকেই তো বড় পর্দার জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন, আপনি কবে বানাবেন?

সুমন আনোয়ার : অমিতাভ বচ্চনের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনার পুরো জীবন বিশ্লেষণ করতে হলে কতটুকু পরিশ্রম আর কতটুকু ভাগ্য? তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ২০ ভাগ পরিশ্রম আর বাকিটা ভাগ্য।’ আমি বিশ্বাস করি, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে শিল্প সম্পর্কিত। যখন ওপরওয়ালার তরফ থেকে আমার সিনেমার নির্দেশ আসবে, তখন চারদিকে তুফান হলেও দেখা যাবে আমি সিনেমার শুটিং করছি। আমার কিন্তু পাঁচটা সিনেমার প্রোডাকশন ডিজাইন শেষ। স্টোরিবোর্ড বানাচ্ছি। এই স্টোরিবোর্ড দেখলেই একজন মানুষ পুরো সিনেমাটা দেখে ফেলতে পারবেন। তার মানে আমার সিনেমার কাজ কতটা এগিয়ে আছে, বুঝতেই পারছেন। আমি যখন বানাব, তখন সিনেমাই বানাব। শুধু কাউকে গিয়ে বলা হচ্ছে না, আমি সিনেমা বানাতে চাই। আমি মনে করি যে প্রায় ৩০ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি। আমার ডেডিকেশন, সিনসিয়ারিটি, ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আমার সততা—কমবেশি সবারই জানা। তারপর নতুন করে কি গিয়ে বলব, আমি একটা সিনেমা বানাতে চাই? আমি আমার কাজটা করে যেতে চাই। এর মধ্যে কেউ না কেউ ঠিকই বলবেন, সিনেমা বানাচ্ছেন না কেন? তখন বলব, আমার তো সবকিছু রেডি। ফাইন্যান্সের জন্য আমি কারও কাছে যেতে পারছি না। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভবও নয়। কেউ যদি এসে বলে পরদিনই সিনেমার কাজে লেগে যেতে পারব। আমি পুরোপুরি তৈরি।

সুমন আনোয়ার
চরকির সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আপনার দৃষ্টিতে ‘ভালো গল্প’ বলতে কী বোঝায়?

সুমন আনোয়ার : যে গল্প মানুষকে নতুন ভাবনা, নতুন ছোঁয়া বা নতুন রস দেবে—সেটাই ভালো গল্প। নতুনটা অনেক বেশি জরুরি। প্রতিটি গল্পই তো একটা জীবন, জীবনের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে মানুষের সামনে খুব টাচি ওয়েতে উপস্থাপন করা, পরিচালক যে টাচি ওয়েতে গল্পটা বলতে চেয়েছেন, দর্শক অতটুকু অনুভব করলে তার গায়ে গুজবাম্প হবে এবং তখনই সে জীবনটাকে অনুধাবন করবে—এটাই আমার কাছে মনে হয় স্টোরি টেলার বা একজন পরিচালকের প্রধান কাজ। আমি মনে করি, শিল্পী হওয়ার আগে একজন মানুষকে অবশ্যই অবশ্যই সৎ মানুষ হওয়া প্রয়োজন। সৎ মানুষ ছাড়া শিল্পকর্ম সম্ভব নয়, এটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি।

প্রথম আলো :

একই সঙ্গে অভিনেতা ও পরিচালক হওয়া কি আপনার সৃষ্টিশীলতাকে বাড়ায় নাকি কমিয়ে দেয়?

সুমন আনোয়ার : অবশ্যই বাড়ায়। একই সঙ্গে অভিনয় করছে এবং পরিচালনা করছে—এ রকম মানুষ হাতে গোনা, কয়েকজন। সেই কয়েকজন এতটাই সৌভাগ্যবান, নিজের সেটে পরিবার পাচ্ছে, অন্য সেটে গিয়ে আরেকটা পরিবার পাচ্ছে। সেখানে রূপসজ্জা, কস্টিউম, সহশিল্পীসহ আরও নানান সেক্টরের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। নতুন মানুষকে চিনছি এবং আমার গুডবুকে তাদের নাম উঠে যাচ্ছে, যা আমার পরের কাজের ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি হেল্প করে।

প্রথম আলো:

জন্মদিন মানে আপনার কাছে কী? উদ্‌যাপন না আত্মোপলব্ধি?

সুমন আনোয়ার : লাইফ ইজ বিউটিফুল। আমি জীবন যাপন করি না, সব সময় উদ্‌যাপন করি। প্রতিটি মুহূর্ত উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়েই তো একধরনের আত্মোপলব্ধি হয়, যেটার মাধ্যমে মানুষ বয়ে নিয়ে যায় তার কাজের অভিজ্ঞতা, সৃষ্টিকর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। আমরা শুধু আমাদের বা আমাদের আগের প্রজন্মের শুধু ভালোটাই বহন করে নিয়ে যেতে চাই আগামী প্রজন্মের কাছে। আমরা যুদ্ধ চাই না, ঘৃণা চাই না, আমরা অত্যাচার চাই না, দুঃখ-কষ্ট চাই না। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ যদি প্রার্থনা করে—হে সৃষ্টিকর্তা, পৃথিবীকে তুমি অদ্ভুত সুন্দর, ভালো এবং পবিত্র করে দাও। প্রত্যেকের মনে সুন্দর ভাবনা দাও। কেউ কারও প্রতি অত্যাচার, অন্যায় করবে না—এমনটা করে দাও। পরে আপনি অবশ্যই দেখবেন, কালকের পৃথিবী ফুলে ফুলে ভরে গেছে। পৃথিবীতে এমন সুন্দর বাতাস বইবে, যা শুধু গুড উইশের কারণে।