আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না...
রেহান রাসুল : রোববার নতুন একটা গানে কণ্ঠ দেব। তাই রেওয়াজ করছিলাম।
প্রথম আলো :
বেলা তিনটার সময় রেওয়াজ!
রেহান রাসুল : ঘুম থেকে ওঠার ওপর আমার রেওয়াজ নির্ভর করে। যদি সকাল নয়টায় উঠি, তাহলে তখন এক ঘণ্টা রেওয়াজ করি। দুপুর কিংবা বিকেলে উঠলে একইভাবে এক ঘণ্টা করি।
গানের প্রস্তাব পেলে সঙ্গে সঙ্গেই গেয়ে ফেলেন, নাকি নিজের মধ্যে কোনো বাছবিচার কাজ করে?
রেহান রাসুল : বললে দাম্ভিকতার মতো শোনাবে, আসলে তা না। আমি প্রথমে গানটা শুনি। দেখি যে আমার আয়ত্তের মধ্যে আছে কি না। ভালো গাইতে পারব কি না। গানটা খুব ভালো কি না। আমার ভালো লাগছে কি না। এই কয়েকটা বিষয় চূড়ান্ত হলে সম্মানী নিয়ে আলাপ করি। আর একটা গান গাওয়ার আগে কমপক্ষে দুটি দিন সময় চেয়ে নিই। ওই দুই দিন রেওয়াজ না করে কণ্ঠ দিতে পারি না।
প্রথম আলো :
ভালো গান বলতে কী বোঝেন?
রেহান রাসুল : ভালো গান বলতে সহজ-সুন্দর কথার গান। মিক্স-মাস্টারিং ভালো হবে। কথায় কোনো অশ্লীলতা থাকবে না। মজা থাকতে পারে, আনন্দ থাকতে পারে, ফ্লার্ট থাকতে পারে; কিন্তু অশ্লীলতা থাকবে না। আমার গাওয়ার ক্ষেত্রে এটুকু আমি সব সময় খেয়াল রাখি। যখন কোনো গান ভিডিওর মাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভিডিওতে অনেক কিছু চলে আসে। একই ধরনের কথার দুই রকম করে উপস্থাপন, সেই গান আবার ভালো প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো :
সৃজনশীল মানুষ মানুষের চাহিদা বুঝে কাজ করবে, নাকি তাঁদের কাজ দিয়ে মানুষের রুচি ও মনন তৈরি করবে?
রেহান রাসুল : আমি মনে করি, সৃজনশীল মানুষ তাঁর সৃষ্টিকর্ম দিয়ে মানুষকে ডমিনেট করবেন। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মেয়ে কৌশিকী চক্রবর্তীর একটা কথা বলতে চাই, ‘আপনি যদি একজন শিল্পী হন, আপনি যদি সৃষ্টি করতে পারেন, তার মানে, আপনি সাধারণ জনগণের চেয়ে একটু হলেও ওপরে। তাহলে আপনিই ঠিক করবেন, সাধারণ জনগণের কী শোনা উচিত। যদি মানুষের কথা অনুযায়ী আপনি কিছু বানান, তাহলে আপনি শিল্পী নন, ব্যবসায়ী।’ আমি একসময় আমার রেডিও শোতে বলতাম, আমি নিজেকে ভিন্ন ধরনের আরজে বলি। কারণ, আমি সেই কথাগুলো বলি, যেগুলো মানুষের শোনা উচিত। ওগুলো বলে শ্রোতাকে কাছে টানি না, যেগুলো বললে শ্রোতা শুনতে চায়। আমি ছোটবেলা থেকে এই চর্চা করছি। এটা যদিও ব্যবসাসফল চর্চা না, এটাও সবার জানা উচিত।
কাছাকাছি সময়ে আপনার গাওয়া আধডজন গান প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে কোন গানটির জন্য সাড়া বেশি এসেছে?
রেহান রাসুল : ‘মন দুয়ারি’ নাটকের ‘এত প্রেম এত মায়া’ গানটার জন্য অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। এমন মানুষেরা আমাকে মতামত জানিয়েছেন, যাঁরা সাধারণত গান নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না। চুপচাপ থাকেন। আর সত্যি বলতে, ফাটাফাটি সাড়া পাচ্ছি ‘আমলনামা’র ‘মনের মানুষ’ গানটির জন্য। একটা স্যাড গান, যেখানে নায়িকাকেও দেখা যাচ্ছে না, যেখানে নায়ক পুরোনো দিনের জাহিদ হাসান, যেখানে এখনকার মতো কোনো চমক নেই, সেই কষ্টের একটা গান মানুষ শুনছেন, কষ্টের পরিস্থিতিতে থেকেও—এটা সত্যিই অন্য রকম সাড়া। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার, ভালো গান শোনার মানুষ আছে, তবে সেটা গণ্ডিবদ্ধ। আজকে এটা যদি আইটেম গান হতো, এতক্ষণে ১০ মিলিয়ন ভিউ হয়ে যেত। ‘মনের মানুষ’ হচ্ছে ভীষণ আবেগের একটি গান, মানুষ একেবারে নীরবে-নিভৃতে না থাকলে শুনতে পারে না।
প্রথম আলো :
আপনার দৃষ্টিতে স্থায়িত্ব কোন ধরনের গানের বেশি।
রেহান রাসুল : স্থায়িত্ব অবশ্যই ‘মনের মানুষ’ ধরনের গানের বেশি। রোমান্টিক, স্যাড গানের বেশি। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে হবে, গানের স্থায়িত্ব আর শিল্পীর স্থায়িত্ব এক নয়। যখন গানের স্থায়িত্ব থাকে, কিন্তু শিল্পীকে মর্যাদাটা দিই না সেই গান অনুযায়ী, তখন শিল্পীর স্থায়িত্ব থাকে না। পরবর্তী সময়ে শিল্পীও ওই ধরনের গান আর করেন না। কারণ, শিল্পী সাড়া পান না। সাড়া না পেয়ে শিল্পী স্পনসর পাননি। স্পনসর পাননি বলে শিল্পী পরের গানটা বানাতেই পারেননি। এখানে তাই শিল্পীর আর শিল্পের স্থায়িত্ব আলাদা।
প্রথম আলো :
আপনি নিজেকে কোন স্থায়িত্বে রাখতে চান?
রেহান রাসুল : দুটোতেই রাখতে চাই। একজন শিল্পী হিসেবে আমি চাই এমন একটা জায়গায় পৌঁছাব, আমি যে গানটা গাইব, ১০ লাখ মানুষ শুনে বলবে যে গানটা খুব বাজে হয়েছে। না শুনে, গানটা এড়িয়ে যাক এমনটা আমি চাই না।
আপনি তো রোমান্টিক গানই বেশি গেয়ে থাকেন। এর বাইরে অন্য কোনো ধাঁচের গানে নিজেকে দেখতে চান?
রেহান রাসুল : ‘তুফান’ সিনেমায় ‘আসবে আমার দিন’ গানটা কিন্তু রোমান্টিক না। এটা স্যাড গানও না। এই গানে আশাবাদের কথা বলা হয়েছে। একটা ছেলে, যে স্বপ্ন দেখছে, সেই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভিন্ন রকম একটা অ্যাটিটুড-প্লেব্যাক যেটাকে বলে। ‘মনের মানুষ’ গানটা যখন গাইলাম, এই গানের শুরুর আগমুহূর্তে একটা শর্ট আছে, গুলির শব্দ পাওয়া যায়। ওই কান্নাটা আমি গানে আনার চেষ্টা করেছি। যে লোকটা মারা গেছেন, তিনি তো কাঁদতে পারেননি। আমি কাঁদব গানের মাধ্যমে-প্লেব্যাকের এই ব্যাপারটা সত্যিই অন্য রকম। এই ভিন্ন রকমটাই করতে চাই। আমি চাই সংগীত পরিচালকেরা আমাকে বলুক, তারপর আমি না পারলেও বলুক, তোমাকে দিয়ে হবে না। বাসায় চলে যাও। আমি তারপর তৈরি হয়ে তিন বছর পর আবার আসব। কিন্তু সুযোগ চাই, অডিশনটা দিতে চাই।
প্রথম আলো :
ফেসবুকে দেখলাম, আবার নতুন করে উপস্থাপনাও করছেন।
রেহান রাসুল : চেষ্টা করছি, ড্রপবক্স নামের একটা অনুষ্ঠান করার। সাত পর্ব রেকর্ড করেছি। মানুষের দৈনন্দিন কিছু অভিযোগ থাকে না, সেই ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা। তারকা দিয়ে শুরু করেছি, সাধারণ মানুষের কথাও শুনব। প্রথম পর্বে ফজলুর রহমান বাবু অতিথি হয়েছেন। পরের পর্বগুলোতে মিছিল (সংগীতশিল্পী আগুনের ছেলে), শান্তা জাহান, তপু খানসহ আরও অনেককে অতিথি হিসেবে দেখা যাবে।
প্রথম আলো :
সবশেষ ‘তুফান’ চলচ্চিত্রে আপনার গাওয়া গান শ্রোতারা দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন। এরপর নতুন কোনো চলচ্চিত্রে গেয়েছেন?
রেহান রাসুল : এরপর আর কোনো ছবিতে গান করা হয়নি। ডাক পাইনি। বেশ কয়েকটি বড় বাজেটের সিনেমা সামনে দিয়ে আসছে আর চলে যাচ্ছে। মনে মনে নিজেকে একটু বরবাদ লাগছে। (হাসি)। তারপরও দেখি, এসব কষ্টে ভবিষ্যতে যদি দাগি আসামি হওয়া যায়, তাহলে হবো।
সামনে তো ঈদ। এই ঈদে আপনার কাছ থেকে শ্রোতারা কী গান পেতে পারেন?
রেহান রাসুল : আমি নিজের সুর ও কথায় একেবারে ভিন্ন রকম একটা গান করছি, ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে গান। গানের নাম হচ্ছে ‘হাই’।
প্রথম আলো :
আপনার গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গান ‘বাজে স্বভাব’। শ্রোতা হিসেবে যদি বলেন, গানের জনপ্রিয়তার পেছনের কারণ কী?
রেহান রাসুল : দুটি কারণ আছে, গানটার কথা অনেক সহজ। এই কথা সবাই বলে। বাংলাদেশে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না, যে বলে না, ধুর আমার এই বাজে স্বভাবটা আর গেল না। এর বাইরে প্রত্যেকটা নারী, পুরুষ বলি না কেন—প্রেম, বিচ্ছেদের ঘটনা জীবনে আছে। এটাকে কষ্ট হিসেবে ধরে। ‘বাজে স্বভাব’ গানে এটাকে একটা মজা বানিয়েছি। এটা মানুষের জন্য ভালো হয়েছে, না, আমার কষ্ট নাই। আমার শুধু একটা বাজের স্বভাব আছে, মাঝেমধ্যে ছ্যাঁকা খাই—এই। এই কারণে হয়তো। দ্বিতীয় কারণ, এই কম্পোজার পৃথ্বীরাজ, তিনি মানুষের পালস বুঝতেন। আজকালকার যেসব কম্পোজার ৬ লাখ, ৭ লাখ টাকা নেন গান বানাতে, পৃথ্বীরাজ ওই লেভেলের কম্পোজিশন আমাকে ওই সময়ে মাত্র ১৮ হাজার টাকায় ‘বাজে স্বভাব’ গানটি করে দিয়েছেন। কারণ, তাঁর সেই জ্ঞানটা ছিল। তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেছিলেন, রাতের পর রাত বসে ঠিক করেছেন, কোন বিট ব্যবহার করা হবে। কোনটি ভালো লাগবে? ভোর চারটায় সময় ফোন দিয়ে বলতেন, ‘রেহান ভাই, দেখেন তো, এটা ভালো লাগে কি না।’ গানের পেছনে একজন কম্পোজার যখন এভাবে লেগে থাকেন, গান হিট না হয়ে পারে? অবশ্যই হবে। পৃথ্বীরাজকে ভয়াবহভাবে মিস করি। তিনি বেঁচে থাকলে আপনারা এমন কিছু গান পেতেন, বাংলাদেশ হাঁ করে তাকিয়ে থাকত।
‘আমার এই বাজে স্বভাব কোনো দিন যাবে না’—এই গানের সূত্র ধরে শুনতে চাই, আপনার জীবনেও কোনো বাজে স্বভাব আছে? থাকলে সেটা কী?
রেহান রাসুল : আমার জীবনে বাজে স্বভাবের অভাব নেই। যদি বলি, আমি মানুষের জ্ঞান ও গুণ বুঝে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা, স্নেহ ও সম্মান করতে পারি এবং আমার বাজে স্বভাব হচ্ছে, এটার মূল্যায়ন যখন তারা করে না, ঠিক উল্টোটা আমি ভালোভাবে করতে পারি। এবং আমার বিন্দুমাত্র মায়াও লাগে না।
প্রথম আলো :
গানে গানে বলেছিলেন, গলা বেচে খাবেন। এই সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক মনে করছেন?
রেহান রাসুল : এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১৬ বছর আগে, গানে গানে বলেছি ছয় বছর আগে। সিদ্ধান্তটা কখনোই সঠিক ছিল না, যদি আমি অর্থনৈতিকভাবে চিন্তা করি। সারভাইভাল চিন্তা করি। যদি আমি আজকে এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু হয়, খুব খুশি হব, আজকে রেহান রাসুল একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে মৃত্যুবরণ করছি। আমার কোনো দুঃখ নেই। অর্থনৈতিকভাবে কারও যদি ইচ্ছা থাকে যে বড় কিছু করবে শুধু গান গেয়ে, তাকে অনেক আখের গুছিয়ে, পিআর রেডি করে তারপরে আসতে হবে। রেওয়াজ পরে, আগে পিআর। আর যদি সংগীতশিল্পী হতে চায়, তবে আগে রেওয়াজ, পিআর তারা পারে না।
কয়েক বছর ধরে অনেক গানই কণ্ঠে তুলেছেন। আপনার গাওয়া দ্বৈত গানে সহশিল্পী হয়েছেন কেউ কেউ। এর বাইরে এমন কারও সঙ্গে গাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন?
রেহান রাসুল : সত্যি কথা বলতে, আমি অনেক সৌভাগ্যবান এদিক থেকে, গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশের প্রথম সারির যত নারী সংগীতশিল্পী আছেন, সবার সঙ্গে গান করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে গান করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই গান প্রকাশিত হয়নি, তার নাম কোনাল। ঘুড্ডির পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর নতুন একটি সিনেমায় আমরা দুজন অসাধারণ একটি গান গেয়েছিলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কোনালের মতো একজন উন্নত কণ্ঠের সঙ্গে আমার গাওয়া গানটি আজও প্রকাশিত হলো না। আমি এই প্রজন্মের সবার সঙ্গে গেয়ে আনন্দ পেয়েছি। আমি গাইতে চাই, এখনো কারও নাম বলতে গেলে কিংবদন্তি রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীন ম্যামের কথা বলব, তাঁদের সঙ্গে যদি ‘আ’ ‘উ’ করারও সুযোগ পেতাম, তাহলে যদি ব্যাক ভোকাল দেওয়ারও সুযোগ পেতাম, সারা জীবন মনে থাকত, ভীষণ অনুপ্রাণিত হতাম।