একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জহির রায়হান ১৯৭১ সালে দুনিয়ার মানুষকে বাংলাদেশে চলতে থাকা গণহত্যার খবর জানান দেওয়ার এক বড় দায়িত্ব কাঁধে নেন। বিশ্ববাসী ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যার কথা জানে, কিন্তু বাংলাদেশে যে তখন শত শত মাই লাই ঘটে চলেছে, সেটা তো বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য এটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। জহির রায়হানের বানানো ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবিটি সে কাজই করেছে। শোনা যায়, জহির রায়হান একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানের সমস্যা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে নেই ছবি বানানোর সরঞ্জামও। ফলে মূলত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া স্টক ফুটেজ ও নিউজ রিলের ছবির ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয় ‘স্টপ জেনোসাইড’। বলা যায়, ‘স্টপ জেনোসাইড’ সম্পাদনার টেবিলে তৈরি হওয়া একটি ছবি। এই চলচ্চিত্র তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম। ২০২১ সালে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই চলচ্চিত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন বরেণ্য এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আজ বিজয় দিবস উপলক্ষে মনজুর কাদের- এর নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করা হলো।
‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরিতে একদিকে যেমন ছিল অর্থসংকট, অন্যদিকে ছিল সরঞ্জামের অপ্রতুলতা। আপনার কাছ থেকে ছবিটি তৈরির গল্পটি শুনতে চাই।
সৈয়দ হাসান ইমাম : মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন জহির রায়হান বললেন ছবি বানাবেন, আমি ইস্ট-ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সেক্রেটারি প্রামাণিকের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁর সঙ্গে আগেও যোগাযোগ ছিল। তাঁর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় এর আগেও অর্থ সাহায্য পেয়েছিলাম। তাঁকে বললাম, আমরা একটা ছবি বানাতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর। তখন তাঁর মাধ্যমে ভারতীয় ১৬ হাজার টাকার ব্যবস্থা হলো। জহির রায়হানকে সেই টাকা এনে দিলাম, বললাম, ‘এই নিন আপনার ফান্ড।’ আমরা ১৬ হাজার টাকায় ‘স্টপ জেনোসাইড’ বানালাম। অপর্ণা সেনের মামাশ্বশুর বড়মাপের ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার ছিলেন, অনেক ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর একটি ক্যামেরা ছিল, এই সিনেমা বানাতে ওই ক্যামেরা তিনি আমাদের দিলেন বিনা খরচে। কীভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা হচ্ছিল, এটা পৃথিবীর মানুষ জানল এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধে একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর কেউ কি আছেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমার তো মনে হয় জীবিত আর কেউই নেই। ওই সিনেমা বানানোর সময় আলমগীর কবির, জহির রায়হান, আলী যাকের ও আমি ছিলাম। আরেকটা ছেলে বোধ হয় ছিল—নুরুল হক বাচ্চু—অ্যাসিস্ট করেছিল জহির রায়হানকে, আমার ঠিক মনে নেই।
বিজয়ের ৫০ বছরে (২০২১ সাল) সাংস্কৃতিক অঙ্গন সামনের দিকে কতটা এগিয়েছে বলে মনে করছেন আপনি?
সৈয়দ হাসান ইমাম : অনেকটাই এগিয়েছে। আমি তো বলব, চলচ্চিত্রে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা খুব প্রতিভাবান। আমাদের কিন্তু ভারতের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না, তাদের অনেক দিনের ঐতিহ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করাও ঠিক নয়। আমাদের দেশের অনুযায়ী আমরা এগিয়েছি। বেশ কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র আমরা পেয়েছি। এটাও ঠিক, সংখ্যাটা কমেছে। সারা পৃথিবীতেই কিন্তু ভালো ছবির সংখ্যা এমনিতেই কম। এখন কোনো দেশে বছরে ৫০০ সিনেমা তৈরি হলে মাত্র ৫টি ভালো ছবির খবর পাওয়া যায়। আমরা শুধু ভালো ছবির খবরটা পাই। শিল্পসম্মত ছবি সারা পৃথিবীতে কম, আমাদের এখানেও কম। এটাও ঠিক, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রতিভাবান। আমি মনে করি, তারা ক্রমেই এগিয়ে যাবে।
নতুন প্রজন্মের যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের ব্যাপারে আপনার কোনো পরামর্শ?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমি পরামর্শ দিতে যাব না। আমি বলতে চাই, সংস্কৃতি ব্যবহার করে শুধু নিজের উন্নয়ন নয়, দেশ ও মানুষের কল্যাণেও ব্যবহার করা দরকার। সংস্কৃতি নিজের অর্থ উপার্জন ও সুনাম অর্জনের জিনিস নয়। সংস্কৃতি জনগণ ও দেশের কল্যাণে ব্যবহার করার একটি বড় অস্ত্র।
আপনাকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতে দেখেছি। এই অঙ্গনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছু বলবেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আসলে চলচ্চিত্রে সোনালি দিন আর কোনো দিন আসবে কি না, আমি জানি না। সারা পৃথিবীরও একই দশা। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে ভারত ও আমেরিকায় চলচ্চিত্রের যে অবস্থা ছিল, সেখানেও তেমনটা নেই। তুলনা করাটাও ঠিক নয়।