২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আপনাদের ‘শোনো মহাজন’ নতুন করে আলোচনায় আসে আবার।
ইমরুল করিম এমিল : আমরাও দেখেছি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীরা গানটি নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের কাছে এই সময় গানটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল। আমার কাছে মনে হয়, শোনো মহাজন গানটি যেকোনো আন্দোলন, অনিয়ম, লড়াই-সংগ্রামে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
‘শোনো মহাজন’ গানের মূল বার্তা ‘ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা’। এটি কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত চিন্তাধারার সঙ্গে মিলে যায়?
ইমরুল করিম এমিল : গানটা ২০১৪ সালে বানানো, প্রকাশিত হয় ‘ভাগো অ্যালবামে’। ‘শোনো মহাজন’ গানটা আসলে অফিসে কাজ করেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন—এমন কেউ কেউ অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন। আমার মনে আছে, প্রকাশের পর গানটিকে অনেক নারীও তাঁদের অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন। অনেকে আমাদের জানিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকার পাচ্ছিলেন না, এই গান তাঁদের একটা কণ্ঠস্বর, যিনি যেভাবে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন আরকি।
প্রথম আলো :
‘শোনো মহাজন’ গানে কোন ধরনের মহাজনের কথা বলা হয়েছে?
ইমরুল করিম এমিল : আমি ওই সময় ছিলাম তরুণ করপোরেট। গানের পাশাপাশি আমি সব সময় চাকরিও করেছি। আমারও মনে হয়েছে, আমার করপোরেট জীবনের সঙ্গে গানের সংযোগ খুঁজে পেয়েছিলাম।
গানটি কীভাবে সৃষ্টি হলো?
ইমরুল করিম এমিল : গানের সুরটা আমরা আগে করেছিলাম, সুরের ওপর লিখেছিলেন শাহান কবন্ধ। লোক আঙ্গিকের একটা সুর আমাদের মাথায় ছিল। যখন সুর তৈরি হয়, তখন আসলে এত কিছু মাথায় ছিল না। আমাদের চিন্তায় শুধু এটুকু ছিল, গানটা যেন অনুপ্রেরণা হিসেবে মানুষ গ্রহণ করেন। কীভাবে অনুপ্রাণিত হবেন, তা অবশ্য শাহান ভাইয়ের মাথা থেকেই এসেছে। ফুয়াদ (আল মুক্তাদির) ভাই ছিলেন এই অ্যালবামের প্রডিউসার। হঠাৎ তিনি আমাদের ব্যান্ডের সবাইকে তাঁর বনানীর স্টুডিওতে ডাকেন। বললেন, ‘অনেক দিন আমরা একসঙ্গে কাজ করি না। চলো, একসঙ্গে কাজ করি।’ শূন্য ব্যান্ডের সবাই আসি, শাহান ভাইও এলেন। এরপর আমরা তাঁকে সুরটা দিই। স্টুডিও থেকে বের হয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে গানটা লিখে দেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে গানটা তৈরি হয়ে যায়। সত্যি বলতে, আমাদের মাথায় অত কিছু ছিল না। আমাদের চিন্তা ছিল, অনেক দিন ব্যান্ডের গান প্রকাশ করছি না, একটা নতুন গান লাগবে। শূন্য ব্যান্ড বরাবরই ‘শত আশা’, ‘গড়ব বাংলাদেশ’-এর মতো অনুপ্রেরণাদায়ী গান বানিয়েছে। সেবারও ইচ্ছা ছিল, অন্য গানের পাশাপাশি একটা যদি অনুপ্রেরণা দেওয়া যায়। গানটা যখন তৈরি হয়, তখন অথরিটিকে প্রশ্ন করার যে বিষয় উঠে আসছে, এমনটা হবে ভাবিনি। ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করবে এই গান, তেমনটা মোটেও ভাবিনি।
গানটি যখন বানিয়েছিলেন তখন কি আপনি ভেবেছিলেন, কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে গানটা এতটা প্রভাব ফেলবে?
ইমরুল করিম এমিল : আমরা একদমই ভাবিনি গানটি আন্দোলনে এতটা প্রভাব ফেলবে। প্রত্যাশাই করিনি। ২০১৪ সালে যখন গানটা তৈরি হয়, আমরা তখন অত বড় ব্যান্ডও নই। এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছি শুধু। গান বানাচ্ছি। আমাদের প্রথম ইচ্ছাই ছিল, গান যেন আমাদের শুনতে ভালো লাগে, আমাদের ফ্যানদের শুনতে ভালো লাগে। সত্যি কথা বলতে, ২০২৪ সালের আন্দোলনের আগে এই গান অনেকে চিনতেনও না। তারপর তো ম্যাসিভ হয়ে যায়। আমরা দেখলাম, বিভিন্ন ঘটনার ভিডিওতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছেন। দেখলাম, একেকটা ভিডিও মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউজ পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা যখন মন্তব্য দেখছিলাম, শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, ‘আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না। এই গান শোনার পর রাস্তায় নেমে গেছি।’ তখন তো মনে হচ্ছিল, ও মাই গড! গানটা যথাযথ সার্থকতা পেল, আমরাও কোনো না কোনোভাবে আন্দোলনে অবদান রাখতে পারলাম। এত বড় প্রত্যাশা কখনোই ছিল না।
গানের কথার কয়েকটি লাইন এখন অনেক বেশি উদ্ধৃত হয়—এটি শুনে আপনার অনুভূতি কেমন হয়?
ইমরুল করিম এমিল : অনেক গর্ব অনুভব করেছি। শুধু আমি নই, শূন্য ব্যান্ডের সব সদস্যই আমরা গর্বিত, প্রতিটা সৃষ্টির পেছনে একটা স্বপ্ন থাকে, মানুষ যেন কানেক্ট করতে পারে। শুধু যে গান শুনে বা মিউজিক্যালি পছন্দ করেছে তা কিন্তু না, একটা ভিন্নতা তৈরি করেছে এই গান। আমার মনে হয়, এই গানের লিরিক, কম্পোজিশন, গায়কি সবকিছুকে কানেক্ট করেছে মানুষ। এতে আমরা নিজেদের কমপ্লিট অনুভব করেছি। আমরা যদি আজকেও মিউজিক ছেড়ে দিই, তারপরও এই গানটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমি গীতিকার শাহান ভাইকে প্রথম দিনই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী নিয়ে গানটা লিখেছেন? তিনি মজা করে বলতেন, এলিয়েন নিয়ে লিখছি। তখন তিনি এলিয়েন নিয়ে অনেক ভিডিও দেখতেন...। অনেকে আবার এমনও বলেছিল, এটা কি সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে লেখা কি না? বিষয়টা মোটেও তা নয়। সবাই যার যার মতো করে ভেবেছে আরকি।
১৭ বছরের ব্যান্ড শূন্য একসময় অ্যালবাম ও সিঙ্গেল গান প্রকাশ করেছে, এখন কেন তা অনেকটাই কমে গেছে?
ইমরুল করিম এমিল : একটা কারণ তো সবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা। আমাদের একটা নীতিগত সিদ্ধান্তই ছিল, জীবনে আমরা পরিবার ও চাকরিবাকরিকে প্রধান্য দেব। কিন্তু সংগীত আমাদের ভালোবাসায় থাকবে। মাঝেমধ্যে আমরা যখন গান পছন্দ করব, সবাই একমত হব, তখন গান রিলিজ করব। আমাদের ব্যান্ড সদস্যদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে—এসব গোছাতে আমাদের সময় লেগেছে। বিষয়টা এমন নয়, আমরা গান নিয়ে আলাপ করছি না। আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
প্রথম আলো :
সামনে তার মানে শূন্যর ভক্তদের জন্য কোনো সারপ্রাইজ আসছে?
ইমরুল করিম এমিল : আমরা গানের কাজ শুরু করেছি। কম্পোজিশন চলছে। ৪ থেকে ৫টা গান নিয়ে একটা অ্যালবাম আনব। আগে যেমন ১০টা গান নিয়ে অ্যালবাম হতো, এখন তা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো :
গান ভালোবাসার, কিন্তু পরিবার ও ক্যারিয়ার প্রধান—এটা কোন চিন্তা থেকে আপনারা ভেবেছিলেন?
ইমরুল করিম এমিল : সত্যি বলতে, মনে হয়েছে আমরা যদি সংগীতকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিই, বাংলাদেশে ওই প্ল্যাটফর্মটা এখনো রেডি নয়। সে জন্য আমরা পরিবার, ক্যারিয়ার, চাকরিবাকরি এসব যদি ঠিক রাখতে পারি, তখন মানসিকভাবে আনন্দে মিউজিক করতে পারব। শিল্পীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও পরিবার, ক্যারিয়ার যদি ঠিক থাকে, তাহলে শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মও ঠিকঠাকভাবে করা সম্ভব।
ডিজিটাল যুগে ব্যান্ড মিউজিক টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন মনে হচ্ছে?
ইমরুল করিম এমিল : ব্যান্ড মিউজিক তো অবশ্যই কঠিন। এখন আগের মতো একটা গান বা অ্যালবাম বানিয়ে ছেড়ে দিলে হবে না। আমরা দেখছি, আশপাশে অনেকে অনেক কষ্ট করে একটা গান বানাইছে, অ্যালবাম তৈরি করেছে কিন্তু শ্রোতা কম। চ্যালেঞ্জটা এখন অনেক বেশি। আমরা শূন্য ব্যান্ড শেষ গান প্রকাশ করেছি ‘বেহুলা’, ওটা অনেক হিট হয়েছে। ওই গান নিয়েও আমাদের অত বেশি প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু আমরা ঠিকঠাক একটা মিউজিক ভিডিও দিতে পেরেছি। মনে হয় যে ওই গানের মধ্যে যে একটা গল্প ছিল। কোভিড–পরবর্তী সময়ে মানুষ কানেক্ট করতে পেরেছে। ওখানে সম্পর্কের একটা গল্প ছিল। অন্তিক মাহমুদ ভিডিওটাও সুন্দরভাবে বানিয়েছে। আমাদের মনে হয়, গান যদি বের করি, ঠিকঠাক গল্প বলার মধ্য দিয়েই করতে চাই। তাই বলব, নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো :
আপনি কি মনে করেন সংগীতের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব?
ইমরুল করিম এমিল : নিঃসন্দেহে সম্ভব। ছোটবেলা থেকে আজম খানের গান শুনে আসছি আরও অনেক কিংবদন্তির গানের মাধ্যমে অনেক পরিবর্তন গল্প আমরা শুনেছি। গান দিয়ে তারা পরিবর্তনের কথা বলে গেছেন। আমাদের এই গানটাও ছোট একটা উদাহরণ। তাই বিশ্বাস করি, অবশ্যই সম্ভব।
প্রথম আলো :
গান কি কখনো রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার মাধ্যম হওয়া উচিত?
ইমরুল করিম এমিল : গান তো যোগাযোগের একটা অসাধারণ মাধ্যম। এটা যেকোনোভাবেই ব্যবহার করা যায়। আর যদি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়, সেটাও চমৎকার মাধ্যম। আমাদের এ রকম কোনো ইনটেনশন ছিল না, ভবিষ্যতে যদি পারি করব। অভ্যুত্থানে যাঁরা সাহস করে গান বানিয়েছেন, সাহসী যাঁরা র্যাপারস ছিলেন, অনেক তরুণ সংগীতশিল্পী ছিলেন—সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গান বানিয়েছেন, যা আন্দোলন সংগ্রামে প্রভাব ফেলেছে।
আপনি নিজেকে একজন শিল্পী হিসেবে কোন অবস্থানে দেখতে চান—বিনোদনের জন্য, নাকি বার্তা দেওয়ার জন্য?
ইমরুল করিম এমিল : আমার জার্নি তো এন্টারটেইনার হিসেবে। আমার ভালো লাগে, যখন কনসার্ট শেষে মানুষ এসে ছবি তোলে। মানুষ যখন ইউটিউব ভিডিওতে মন্তব্য করে, গানটা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু এটার চেয়ে মাল্টিপল বিষয় নিয়েও বলে। যখন বলে, আমাদের ওই গানটা তার জীবনে একটা প্রভাব ফেলেছে, তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আমি ক্রিকেট খেলোয়াড়দের কাছ থেকেও শুনেছি, মাঠে খেলতে যাচ্ছে, বাসে যখন ‘শত আশা’ গানটা শুনছে, যখন কোনো গান এন্টারটেইমেন্টের চেয়ে নেক্সট লেভেলে চলে যায়, ভিন্নতা সৃষ্টি করে, ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, তখন এটা অনেক বেশি ভালো লাগার। এসব আমাকে আরও পরিপূর্ণতা এনে দেয়।